- গৌতম হোড়
গত লোকসভা নির্বাচনের আগে কাশ্মীরে গিয়ে শ্রীনগরে হোটেল পেতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। যেখানেই গিয়েছি, শুনতে হয়েছে, জায়গা নেই। পুরো ভর্তি। রাস্তাঘাটে সমানে বাংলায় কথা শুনতে পেয়েছি। তা সে শ্রীনগরের লাল চক হোক বা গুলমার্গের রাস্তায়। কাশ্মীরের মানুষের কাছে পর্যটকরা মেহমান। শুধু তো পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা ভারতের মানুষ সেখানে ভিড় করেছেন। এই যে মানুষের ঢল, পর্যটকের স্রোতের লাভ পেয়েছেন কাশ্মীরের মানুষ, সাধারণ মানুষ।
কাশ্মীরে গেলে আপনি দেখতে পাবেন, সেখানে হয় খুব বিত্তবান অথবা নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষ আছেন। মধ্যবিত্তের সংখ্যা খুব কম। কাশ্মীরের পর্যটকরা যে সব জায়গায় যান, সেখানে গরিব মানুষরা বছর কাটানোর রসদ পাচ্ছিলেন ওই পর্যটকদের জন্য। হোটেল, রেস্তোরাঁ, দোকানদার, ঘোড়াওয়ালা, ট্যাক্সির সঙ্গে যুক্ত মানুষ, ট্যুর অপারেটর থেকে শুরু করে হাজারও মানুষ উপকৃত হচ্ছিলেন।
একে কাশ্মীরে প্রচুর সেনা ও আধাসেনা জওয়ান ও পুলিশের উপস্থিতি এবং পরিস্থিতির ওপর নিরাপত্তা কর্তা ও প্রশাসনের কড়া নজর ছাড়াও আরেকটা মিথ পর্যটকদের ভরসা জুগিয়েছিল। সেটা হল, কাশ্মীরে পর্যটকদের আক্রমণ করে না জঙ্গিরা। অতীতে কিছু ঘটনা ঘটলেও তা ব্যতিক্রম হিসাবে ভাবা হত। পহলগামের ঘটনা সে সবকিছুর ওপর নির্মম আঘাত করেছে।
পহলগামে পর্যটকদের হত্যা খুব স্বাভাবিকভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে ভারতীয়দের। খুবই স্বাভাবিকভাবে এতজন পর্যটক এবং এক সহিসের মৃত্যুতে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে, যারা নিরীহ মানুষদের এভাবে খুন করে, তারা মনুষ্য পদবাচ্য হতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ড একইসঙ্গে বদলে যাওয়া কাশ্মীরের ওপর বড় আঘাত হিসাবে এসেছে।
২০১৯-এর পর থেকে কাশ্মীরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর জম্মু ও কাশ্মীর যে বিশেষ অধিকার ভোগ করত, তা বিলুপ্ত হয়েছে, পূর্ণ রাজ্য থেকে জম্মু-কাশ্মীর এখন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, লাদাখকে আলাদা স্বশাসিত অঞ্চল করা হয়েছে, তারপর লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। মানুষ বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। গত কয়েক বছরে লাখ লাখ পর্যটক ভূস্বর্গে গিয়েছেন।
তবে এই একটা ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদকে শিকড় থেকে উপড়ে ফেলা যায়নি। স্লিপার সেলগুলিকে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় করা যায়নি। গোয়েন্দাদের তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে খামতি থেকে গিয়েছে, পর্যটকরা যেখানে যান, সেখানে সুরক্ষা দেওয়ার কাজেও খামতি থেকে গিয়েছিল। এই সব জায়গায় কী করা হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিন্তাভাবনা শুরু করেছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং নেবেও।
কিন্তু আমার চল্লিশ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে এই প্রথমবার দেখছি, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ জঙ্গিদের বর্বরোচিত আচরণের নিন্দায় মুখর হয়েছেন, তাঁরা মিছিল করেছেন। শুক্রবার শ্রীনগরের জামা মসজিদে জুম্মার নমাজের পর এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়েছে, তারপর মিছিল করে মানুষ ঘটনার নিন্দায় সোচ্চার হয়েছেন। ডাল লেকের বোটচালক থেকে শুরু করে সহিসরা, ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে পিডিপি সকলেই একবাক্যে ঘটনার নিন্দা করে প্রতিবাদ মিছিল করছেন।
পরিবর্তন শুধু এটুকুই নয়, এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনার পর কাশ্মীরের মানুষের বড় অংশ এর আগে অভিযোগ করতেন, এ সবই সরকার করিয়েছে। পহলগামের ঘটনার পর কাশ্মীরে যাওয়া আমার সহকর্মীরা জানিয়েছেন, এবার সাধারণ মানুষ খোলাখুলি বলছেন, এটা সরকার করাতে পারে না। জঙ্গিরা করেছে এবং আমরা তাদের কাজের নিন্দা করি। পহলগামের হোটেল, ঘোড়া, ট্যাক্সি, দোকানের সঙ্গে যুক্ত মানুষ সোচ্চারে বলছেন, জঙ্গিরা তাদেরও মারল, তাদের পেটে লাথি মারল। এর ফলে তাদের কোমর ভেঙে গেল।
এটা বদলে যাওয়া কাশ্মীরের চেহারা। কাশ্মীরের বদলে যাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে সংসদের ভিতরে ও বাইরে অনেক দাবি-পালটা দাবি অনেক করা হয়েছে। কিন্তু সত্যিই যে এমন বদল হয়েছে, তা কতজন ভাবতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ভারতের বাকি জায়গায় মানুষের মনোভাব কি বদলেছে? খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, বদলায়নি। বিভিন্ন জায়গায় কাশ্মীরি পড়ুয়ারা নিগৃহীত হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। পড়ুয়ারা কাশ্মীরে ফিরে যাচ্ছে। সব জায়গায় সবসময় বদল কি আর অত সহজে হয়, বিশেষ করে যেখানে ক্রমাগত সুর চড়িয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। নয়াদিল্লিতে বসে আর একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে কিছু সাংবাদিক ও মিডিয়া যেভাবে কথা বলছে, তা দেখে স্তম্ভিত হতে হচ্ছে। আমরা শিখেছিলাম, সাংবাদিকদের কাজ হল, খবর লেখা। এখন তো তাঁরা খবর করা ছেড়ে দিয়েছেন। যে ভাবে ও ভাষায় কথা বলছেন, তা কতটা গ্রহণযোগ্য?
তবে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এরপর কী হবে? ভারত এই ঘটনার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একগুচ্ছ ব্যবস্থা নিয়েছে। পাকিস্তানও পালটা ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছে। প্রাক্তন সেনা অফিসাররা, কূটনীতিকরা বলছেন, বড় প্রত্যাঘাতের জন্য অপেক্ষা করুন। অতীতের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের উদাহরণ আছে। ভারত যে পাঁচটি ব্যবস্থার কথা ঘোষণা করেছে, তার মধ্যে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখা বাদ দিয়ে বাকি সিদ্ধান্ত আগেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত রাখাটা নিঃসন্দেহে নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তবে তা দিয়ে কি পাকিস্তানকে ‘শিক্ষা’ দেওয়া সম্ভব?
আমাদের কাছে দুটি অভিজ্ঞতাই আছে। ভারতের সংসদে জঙ্গি হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী‚ আর পার কী লড়াই-এর কথা বলেছিলেন। পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর সেনা মোতায়েন করা হয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত যুদ্ধ হয়নি। আবার ২০১৬-তে উরি ও ২০১৯-এ পুলওয়ামার ঘটনার পর ভারত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে, অর্থাৎ, পাকিস্তানে ঢুকে জঙ্গিদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হয়। এবারও কি তাই হবে? এবার কি পাক অধিকৃত কাশ্মীর লক্ষ্য হবে? এর জবাব ভবিষ্যৎ দেবে। তবে প্রাক্তন সেনা অফিসার ও কূটনীতিকরা বারবার করে এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, পাকিস্তানের হাতে পরমাণু বোমা আছে। সেটা তাদের বড় ডেটারেন্ট।
তবে এই বদলের তালিকায় আরেকটা বিষয় যোগ করতে হবে। সেটা হল, বিরোধীদের প্রতিক্রিয়া। সর্বদলীয় বৈঠকের পর রাহুল গান্ধি স্পষ্ট করে একটা কথা জানিয়ে দিয়েছেন, সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে, বিরোধীরা তা সমর্থন করবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বলটা সরকারের কোর্টেই ঠেলে দিয়েছে বিরোধীরা। তাদের বদলও কম চমকপ্রদ নয়।
(লেখক সাংবাদিক)