- পূর্বা সেনগুপ্ত
পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত শীলাবতী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে গ্রেট ক্যানিয়ন গনগনি, যার জন্য গড়বেতা বিখ্যাত। অনেক প্রাচীন এই জনপথ। প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় ব্যঞ্জনা যেমন আছে তার সঙ্গে বিরাজ করে মহাভারত যুগের প্রাচীন কাহিনী।
শোনা যায় এই অঞ্চলেই বকাসুরকে বধ করেছিলেন পাণ্ডব ভীম। তখন স্থানটির নাম ছিল বকদ্বীপ। বকাসুর মৃত হয়েছেন জেনে আনন্দিত শ্রীকৃষ্ণ ভীমকে অভিনন্দন জ্ঞাপনের জন্য পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে উপস্থিত হয়েছিলেন এই অঞ্চলে। শ্রীকৃষ্ণর আগমনের সংবাদ পেয়ে যুধিষ্ঠির তাঁকে অভিনব উপায়ে অভ্যর্থনা করতে চাইলেন। সেই অভ্যর্থনার জন্য শ্রীকৃষ্ণের একটি বিগ্রহ তৈরি করা হল। সেই বিগ্রহই বগড়ীর কৃষ্ণরায়জিউ-এর মন্দিরে এখনও পূজিত হচ্ছেন।
এই বিগ্রহ স্থাপনার আরেকটি জনপ্রিয় ও ঐতিহাসিক কাহিনীও আছে। সেটিকে পাশে রেখে আমরা এখন মহাভারতের যুগেই ফিরে যাব।
শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন শীলাবতীর তীরে। এই নদীতীরস্থ জনপথ, প্রকৃতি তাঁর কাছে খুব মনোরম বলে মনে হল। তাই তিনি মনে মনে এই স্থানে বাস করার সুপ্ত ইচ্ছা নিয়ে ফিরে গেলেন দ্বারকায়। শ্রীকৃষ্ণ ফিরে এলেন অনেক পরে ভিন্ন কাহিনীর হাত ধরে।
আমরা অনেক মন্দিরের ইতিহাসের মধ্যে প্রবেশ করেছি কিন্তু মন্দিরের সঙ্গে এক নদীর এত নিবিড় সম্পর্ক আগে কোনও মন্দিরের ইতিহাসের মধ্যে উঁকি দেয়নি। বিগ্রহ দুটি, একটি শ্রীকৃষ্ণের ও অপরটি শ্রীরাধিকার। কিন্তু মন্দির তিনটি। একটি শিলাবতী নদীর বাম তীরে কৃষ্ণনগর গ্রামে। অন্যটি ঠিক নদীর বিপরীত তীরে, রঘুনাথবাড়ি, রঘুনাথ সিং নির্মিত আরেক মন্দির। তৃতীয় মন্দিরটি মায়তা গ্রামে, এই মন্দিরকে বলা হয় মাসির বাড়ি, বছরের রথ ও রাস উৎসব এই মন্দিরেই উদযাপিত হয়।
কৃষ্ণরায়জিউ-এর মন্দির আর রঘুনাথবাড়ি মন্দির- দুই মন্দির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, দুই গ্রাম বিখ্যাত দুটি ঐতিহাসিক মন্দিরকে ধারণ করে গর্বিত। দুই মন্দিরেই পালিত হয় দোল উৎসব। দেবতা কিছুদিনের জন্য বাস করেন সেখানে। এই সময় হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে উৎসবের আনন্দে বিভোর হয়ে ওঠেন। এ হল এই মন্দিরের বিশেষত্ব।
মন্দিরের ইতিহাস পাঠে নিমগ্ন মন নিজেকেই প্রশ্ন করে, এ কি কোনও গৃহদেবতার অধিষ্ঠান? নাকি কোনও গ্রাম্যদেবতা? কিন্তু এত ছোট বৃত্তের মধ্যে এই দেবালয়কে সীমাবদ্ধ করা যাবে না। কারণ, এই দেবালয়ের কাহিনী বাংলার ধর্ম আন্দোলনের বা ভক্তি আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য পুরোধা পুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের সঙ্গেও গাঁটছড়া বেঁধেছে। পাঠক বুঝতেই পারছেন কত ডালপালা বিস্তার করে ইতিহাসের গায়ে মহাবৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এই বিগ্রহ কৃষ্ণরায়জিউ।
শোনা যায়, প্রাচীনকালে এই স্থানের নাম ছিল তাল-বেতাল। গুপ্তযুগে রাজা বিক্রমাদিত্য এখানেই তপস্যা করে বেতালসিদ্ধ হয়েছেন। তাঁর আরাধিত দেবী সর্বমঙ্গলার মন্দির এই গড়বেতা শহরেই বিরাজিত। শোনা যায়, গুপ্তরাজা কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে তাঁর দরবারের কর্মচারী ছিলেন বেত্রবর্মা। তিনি এই পুরাণপ্রসিদ্ধ অঞ্চলে একটি শহর নির্মাণ করেন। আর এই নগর রক্ষার জন্য তিনি সেখানে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। দুর্গ অর্থাৎ গড়। বেত্রবর্মা নির্মিত গড় বলে তা ‘বেত্রগড়’ নামে প্রথমে চিহ্নিত করা হত এই অঞ্চলকে। এই নাম ধীরে ধীরে গড় শব্দটিকে সামনে নিয়ে এসে ‘গড়বেত্রা’ রূপে জনমানসে প্রতিভাত হল। বহুকাল পরে তাও সরল হয়ে ‘গড়বেতা’য় রূপান্তরিত হল। তখন সমগ্র অঞ্চল ছিল ছোট ছোট রাজাদের অধীন।
কিংবদন্তি অনুসারে প্রায় সাতশো বছরের প্রাচীন এই মন্দির। এই মন্দিরের কিছু দূরে আমলাগড়ের বিখ্যাত পিয়াসোল জঙ্গল সামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের ছেলে সিহারুদ্দিন বাগর শাহের অধীনে ছিল। তখন এই অঞ্চলের নাম ছিল বগ্রতাতী। কিন্তু এই অঞ্চলের ইতিহাস উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম গজপতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। উড়িষ্যার রাজা পুরুষোত্তম গজপতির পুত্র হলেন প্রতাপরুদ্র গজপতি। হুগলি ও মেদিনীপুর অঞ্চলের কিছু অংশ পুরুষোত্তম গজপতির অধীনে এলে তিনি সেই অঞ্চলের রাজত্ব পুত্র প্রতাপরুদ্রের হাতে সমর্পণ করেন। প্রতাপরুদ্র গজপতি গড়বেতার রাজা হয়ে একটি পৃথক বংশের সূচনা করেন এবং গজপতি সিং রূপে চিহ্নিত হন।
গজপতি সিংয়ের দেওয়ান ছিলেন মুকুন্দরাম বটব্যাল। তাঁর আদি গ্রাম ছিল নদিয়ায়, সেখান থেকে তিনি বগড়ীতে এসেছিলেন। তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য তিনি রাজ্যধর নাম পান এবং তার সঙ্গে রায় উপাধি। এরপর থেকে তিনি রাজ্যধর রায় নামেই পরিচিত হতে থাকেন। রাজ্যধর রায় অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তাঁর ঈশ্বরপ্রাণতা তাঁকে বিশেষ মানুষে পরিণত করে তুলেছিল। তিনি একবার কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি তীর্থ ভ্রমণ করতে করতে নীলাচলে উপস্থিত হলেন। সেখানে পুরী জগন্নাথ মন্দিরের কাছেই এক জয় পান্ডা নামে সাধক ও কারিগর ছিলেন। সেই কারিগরের গৃহে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সনকা আতিথ্য গ্রহণ করলেন। কারিগর জয় পান্ডা সাধক ছিলেন তাই তাঁর গৃহেও এক অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি পূজিত হয়ে আসছিলেন দীর্ঘকাল ধরে।
নীলাচল বাসের সময় একদিন রাজ্যধর রায় স্বপ্ন দেখলেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁকে বলছেন, ‘আমি বগড়ী যেতে চাই। সেখানে গিয়ে শীলাবতী নদীর তীরে নতুন মন্দিরে অধিষ্ঠিত হয়ে বিরাজ করব, এই আমার একান্ত ইচ্ছা। তুমি জয়কে বললে সে আমার বিগ্রহ তোমায় প্রদান করবে।’ পরদিন রাজ্যধর রায় জয় পান্ডাকে স্বপ্নাদেশের কথা জানালেন। জয় পান্ডা একটি কৃষ্ণমূর্তি তৈরি করে রাজ্যধর রায়কে দিলেন। সেই মূর্তি নিয়ে সস্ত্রীক রাজ্যধর রায় রওনা হলেন বগড়ীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে আবার স্বপ্নাদেশ এল, স্বপ্নে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘যে মূর্তিতে আমি বগড়ী যাব জয় তোমাকে সেই মূর্তি দেয়নি। তুমি ফিরে গিয়ে তাঁর আরাধিত মূর্তি চাও। আমি সেই মূর্তিতে অধিষ্ঠিত আছি। দেখবে সেই মূর্তির মুখমণ্ডলে একটি ছোট মাছি অঙ্কিত আছে।’ স্বপ্নাদেশ পেয়ে আবার জয় পান্ডার গৃহে ফিরে গেলেন দুইজন। এবার দেখলেন জয় পান্ডা দুরারোগ্য শূলবেদনায় কাতর। কিছুতেই তিনি সুস্থ হচ্ছেন না। আরাধিত মূর্তিকে কাতরে সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেন জয়। আবার স্বপ্নাদেশ হয়। রাজ্যধর রায়ের কাছে স্বপ্নপ্রাপ্ত ওষুধ আছে। সেটি সেবনেই রোগমুক্তি ঘটবে।
জয় পান্ডা এবার রাজ্যধর রায়ের শরণাপন্ন হন। তাঁর দেওয়া ওষুধে তিনি কেবল সুস্থ হলেন না, তিনি বুঝতে পারলেন আরাধিত মূর্তিকে এবার রাজ্যধর রায়ের হাতে সমর্পণ করতেই হবে। রাত শেষে দিনের সূচনা হল। রাজ্যধর কৃষ্ণ বিগ্রহ লাভ করলেন, কিন্তু রাধারানি ছাড়া কৃষ্ণ থাকেন কী করে? আর কৃষ্ণ বিগ্রহ পাথরের নির্মিত। তাঁকে নিয়ে এতটা পথ হাঁটবেনই বা কী করে! শ্রীকৃষ্ণ জানালেন, ভয় নেই! যেই তুমি আমাকে আলিঙ্গন করবে অমনি আমার শরীর পালকের মতো হালকা হয়ে যাবে। কৃষ্ণ যেমন বগড়ী যেতে আগ্রহী, শ্রীরাধিকা কিন্তু ততটা নন, তিনি নিমরাজি হয়ে রাজ্যধর পত্নী সনকাকে জানালেন, ‘আমি তোমার পিছন পিছন যাব। তুমি বাঁশি আর নূপুরের ধ্বনি শুনতে পাবে। কিন্তু সাবধান, কখনও পিছন ফিরে আমায় দেখতে চেয়ো না। যদি দেখো তবে আমি সেখানেই অধিষ্ঠিত হয়ে যাব।’ ভক্ত ভগবানের শর্ত মেনে নিলেন। নারায়ণগড়, লালগড়ের পথ ধরে উড়িষ্যার নীলাচল থেকে পায়ে হেঁটে রাজ্যধর রায় সেই পালকের মতো হালকা হয়ে যাওয়া কৃষ্ণ বিগ্রহকে নিয়ে চলতে লাগলেন। দুটি হাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ, পরম আদরের বিগ্রহ!
পথে অনেক অলৌকিক ঘটনার সম্মুখীন হলেন তাঁরা। শ্রীকৃষ্ণ লীলাচ্ছলে এগিয়ে গিয়ে, বালকের বেশ ধরে কারও কাছ থেকে দুধ, ননী, ছানা ইত্যাদি কিনে খেতে শুরু করলেন। আর দাম চাইলে একই উত্তর, ‘আমার বাবা আর মা পেছনেই আছেন। তাদের কাছ থেকে কড়ি নিয়ে নিও।’ রাজ্যধর রায় যেই সেই গ্রাম অতিক্রম করতে গেলেন অমনি, কড়ি দাও। বর্ণনা শুনে রাজ্যধর বুঝতেই পারলেন কে দুধ, ননী, ছানা এইসব খেতে খেতে চলেছেন।
আজও সেইসবই নিষ্ঠা সহকারে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। বিশেষ করে দুধলুচি। জগন্নাথের যেমন গজা, কৃষ্ণরায়জিউ-এর দুধলুচি।
একদিকে নূপুর আর বাঁশির শব্দ, অন্যদিকে এই আবদার করে খেতে চাওয়া। পরম আনন্দে দুই ভক্তমন এগিয়ে চলেন। অবশেষে পথে পড়ল গোয়ালতোড়। এই গোয়ালতোড়ে গজপতি সিং-এর কনিষ্ঠ পুত্র পৃথক রাজ্যের স্থাপনা করেছিলেন। রাজ্যধর রায় আর সনকাদেবী সেখানেই এক গাছের তলায় বসলেন পথশ্রম লাঘব করতে। এই সময় হঠাৎই পিছন থেকে ভেসে আসা বাঁশি আর নূপুরের শব্দ থেমে গেল। কেন স্তব্ধ হল? তবে কি রাধিকা আর আসছেন না? অত্যন্ত শঙ্কিত সনকাদেবী রাধিকার শর্ত ভুলে পিছন ফিরে দেখতে গেলেন। সঙ্গে শ্রীরাধিকা প্রকট হয়ে বললেন, ‘সনকা, তুমি আমার শর্ত ভেঙে বিপরীত কাজ করেছ। আমি এখানেই অধিষ্ঠিত হলাম। আর তোমাদের সঙ্গে বগড়ী যাব না।’
রাজ্যধর, বিশেষ করে সনকা অনেক কান্নাকাটি ও অনুরোধ করলেন। রাধিকা কিন্তু কিছুতেই যেতে রাজি হলেন না। তখন সনকা ভক্ত হয়েও তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, ‘তুমি আমায় ছলনা করলে। রাজার সেবা, ব্রাহ্মণের সেবা যখন তোমার মনে রুচল না, তবে তুমি আজ থেকে নিম্নবর্ণের পূজা ও তামসিক সেবা গ্রহণ করো।’ শোনা যায় আজও একাকী শ্রীরাধিকা গোয়ালতোড়ে অধিষ্ঠিতা। তিনি নাপিত, কামারদের মাধ্যমে পূজিত হন এবং এই রাধিকা মূর্তির সম্মুখে আজও বলি হয়। এই রাধিকা রক্তপ্রিয়া। এ এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের চমকে দেয়। এক মুহূর্তে রাধিকা চরিত্রে ব্যঞ্জনাই পুরোপুরি পালটে যায়।
রাধা রয়ে গেলেন পথমাঝে। কেবল কৃষ্ণ চললেন বগড়ী। বগড়ী পৌঁছে রাজ্যধর রায় সমস্ত ঘটনা রাজা গজপতি সিংকে জানালেন। আমরা জানি গজপতি সিং-এর আদি বাসস্থান উড়িষ্যা নীলাচলে। তাঁর কাছে এই ঘটনা একটি অভূতপূর্ব আশীর্বাদের মতো। তিনি মহাসমারোহে শুরু করলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ। মন্দির গঠিত হল। রাজা দক্ষিণ ভারত থেকে উপেন্দ্র ভট্ট নামে এক সংস্কৃতিজ্ঞ ব্রাহ্মণকে পূজারি রূপে নিয়ে এলেন। এখনও ভট্টপুর সেই ভট্টদের বসবাসের নিদর্শন রূপে বেঁচে আছে।
এর সঙ্গে রাজা ৫২ বিঘে জমি কৃষ্ণরায়জিউ-এর জন্য দেবোত্তর করে দেন। সেই জমির আয় থেকে ৫২টি কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়। কারও কাজ ফুল তোলা, মালা গাঁথা ইত্যাদি। গজপতি সিংয়ের পর রাজা হন তাঁর পুত্র হাম্বির সিং। তিনি মদ্যপ ও উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতেন। মাত্র পাঁচ বছর রাজত্ব করার পর তিনি মারা যান। রাজা হন প্রথমে বড় পুত্র, শেষে কনিষ্ঠ পুত্র রঘুনাথ। গজপতি সিং-এর নাতি রঘুনাথ সিং-এর সময় স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে কৃষ্ণের পাশে রাধিকা বিগ্রহ স্থাপিত হয়।
সেই কাহিনীও রোমাঞ্চকর। কৃষ্ণরায়জিউ প্রায় একশো বছর, মতান্তরে সত্তর বছর একাকী পূজা গ্রহণ করে একদিন জানালেন, ‘আমি অনেকদিন একাকী আছি। আমার পাশে রাধাকে চাই।’ এর সঙ্গে শর্ত ছিল একরাত্রের মধ্যে রাধার ধাতুমূর্তি নির্মাণ করতে হবে। রঘুনাথ তখন প্রাণনাথ সাহা নামে এক কারিগরকে সেই কাজের জন্য নিযুক্ত করলেন। সমস্ত রাত্রি জেগে কারিগর তৈরি করতে লাগলেন রাধিকা মূর্তি। প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে, কেবল পিছনের কিছুটা অংশ বাকি তখনই ভোরের কোকিল ডেকে উঠল। প্রাণনাথ কৃষ্ণরায়জিউ-এর পায়ে পড়ে বললেন, ‘হে দেব, আমার যতটা সাধ্য ততটাই করেছি। দয়া করে তুমি এই অসম্পূর্ণ বিগ্রহকেই পাশে বিরাজ করার অধিকার দাও।’ কৃষ্ণরায়জিউ নাকি প্রকটিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আমি তোমার কাজে খুশি হয়েছি, বল তুমি কী বর চাও?’ তখন নাকি প্রাণনাথ বলেছিলেন, ‘সবংশে যেন নিধন হয় আমার।’ কেন?- দেবতাও এই প্রস্তাবে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেন। প্রাণনাথ উত্তর দেন, ‘যিনি ভুবন পালন করছেন তাঁর বিগ্রহকে দেখে কেউ যদি বলে আমার পূর্বপুরুষ এই বিগ্রহের স্রষ্টা তাহলে আমার ভালো লাগবে না।’ ভক্তের ভক্তিতে তুষ্ট দেবতা তাঁর প্রার্থনাই মঞ্জুর করেছিলেন।
রঘুনাথ কেবল রাধিকা মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি শ্রীকৃষ্ণ ও রাধিকার বিবাহ উপলক্ষ্যে নদীর অপর তীরে একটি নবরত্ন মন্দির তৈরি করেন। এক বসন্ত পূর্ণিমার দিন, দোল উৎসবের আড়ম্বরপূর্ণ সমাবেশে নদীর অপর পাড়ের মন্দির থেকে পালকিতে চেপে শীলাবতী নদীর শুকিয়ে যাওয়া নদীবক্ষ অতিক্রম করে কৃষ্ণ আসেন রাধিকাকে বিয়ে করতে। আজও একইভাবে এই দোল উৎসব পালিত হয় অত্যন্ত সমারোহের সঙ্গে।
শোনা যায়, রঘুনাথ সিং-এর কন্যা রাধিকা কৃষ্ণরায়জিউ-কে স্বামীরূপে ভালোবাসতেন। যখন রাধিকা বিগ্রহের সঙ্গে কৃষ্ণরায়জিউ-এর বিবাহ স্থির হয় তখন এই রঘুনাথকন্যা রাধিকা বিগ্রহ রাধিকার মধ্যে বিলীন হয়ে যান। সকলে তাঁকে আর খুঁজে পান না। কেবল চরণের নূপুর ছাড়া। যে স্থানে নূপুরটি পাওয়া যায় সেই স্থানে গড়ে উঠেছে নূপুরগ্রাম। যে ঘাট অতিক্রম করে কৃষ্ণ বিয়ে করতে যান সেই ঘাটের নাম যাদবঘাট। কারণ কৃষ্ণ যদুবংশের সন্তান। রঘুনাথের কন্যা রাধিকা রূপে কৃষ্ণ বিগ্রহকে বিবাহ করেছিলেন বলে আজও কৃষ্ণরায়জিউ-কে রাজপরিবারের জামাই রূপে চিহ্নিত করা হয়। আর পুরোহিত উপেন্দ্র ভট্ট রাজাকে জানিয়েছিলেন এই বিগ্রহ সচল। তাই প্রমাণস্বরূপ তিনি দেখিয়েছিলেন কৃষ্ণরায়জিউ-এর একটি হাতের কড়ে আঙুল নরম, জীবন্ত মানুষের মতো।
বগড়ীর কৃষ্ণরায়জিউ-এর কথায় গৌড়লীলা পার্ষদ অভিরাম গোস্বামীর কথা বলতেই হয়। তিনি বৃন্দাবনলীলায় কৃষ্ণের বাল্যসখা সুদামা ছিলেন। অভিরাম গোস্বামী অনেক প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণবিগ্রহ সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, পূজিত কি না তা পরীক্ষার জন্য মন্দিরে গিয়ে বিগ্রহকে প্রণাম করতেন। আর অপূজিত বিগ্রহ তৎক্ষণাৎ ভেঙে যেত। এইভাবে বিগ্রহ পরীক্ষা করতে করতে অভিরাম গোস্বামী বগড়ীতে উপস্থিত হন। তিনি দেখেন ভগ্নপ্রায় মন্দিরে একাকী কৃষ্ণরায়জিউ। তাঁকে দেখেই চোখ পাকালেন বিগ্রহস্থ কৃষ্ণরায়জিউ। এর ঠিক আগেই বিষ্ণুপুরে মদনমোহন রূপের কাছে বকুনি খেয়েছিলেন অভিরাম। বগড়ীতেও একই অবস্থা।
-পরীক্ষা করা হচ্ছে?
-না না তা নয়! দেখতে এলাম আর কি! তা পুরোহিতকে বলে একটু মিষ্টি আনাও। দুই বন্ধু বসে একত্রে মিষ্টান্ন খাই।
– মিষ্টি এসেছিল, সেই ভগ্ন মন্দিরের দালান জমজম করে উঠেছিল ভক্তিতে। দেবতা জাগ্রত। আজও এই তীর্থে অভিরাম গোস্বামীর পাদুকা রক্ষিত আছে।
ইতিহাস বলে রাজা গজপতি সিং-এর তৈরি মন্দির বহুকাল আগেই নদীর গর্ভে চলে গিয়েছে। রঘুনাথ সিং-এর তৈরি মন্দিরও ভগ্নপ্রায় হয়ে গিয়েছিল। দুটি মন্দিরই সংস্কার করা হয়েছে। শীলাবতী নদী এখানে একটি স্বেচ্ছাচারী উচ্ছ্বসিত আবেগের মতো। এমনি দেখলে মনে হবে এ কি নদী? কেবল ক্ষীণকায় নয়, এই নদীর অর্ধেক অংশ এমনভাবে মজে আছে যে মানুষ এ পাড়ে মন্দিরে প্রণাম করে অন্য তীরে মেলাতে যায় নদীর বুক দিয়ে পায়ে হেঁটে। হয়তো একটু অংশ জল আছে যাতে অনায়াসে পা ডুবিয়ে চলা যায়। এই নদী ভয়ংকর হয়ে ওঠে যখন বর্ষাকাল উপস্থিত হয়। টইটুম্বুর জল সিঁড়ি অতিক্রম করে মন্দিরের উঠোনে উঠে দেবতার বসবাসের অসুবিধে সৃষ্টি করে। মন্দিরের সিঁড়ি তাই অনেক উঁচু অবধি উঠে গিয়েছে। সিঁড়ির চড়াই দেখেই স্রোতের তীব্রতাকে অনুভব করা যায়।
বগড়ী রাজার তৈরি মন্দির যখন শীলাবতীর গর্ভে, তখন বর্তমান মন্দির কবে নির্মিত হল? বলা হয়, বাংলার ১২৬২ সালে গড়বেতার মুন্সেফ কোর্টের উকিল যাদব চট্টোপাধ্যায় এই মন্দির তৈরি করেন। এই মন্দির জাগ্রত ভক্তের কাছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এ মন্দির এক অমূল্য তথ্যে পূর্ণ আরাধনার স্থান।