এখনও যাবে? সাবধানে যেও!

এখনও যাবে? সাবধানে যেও!

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


তৃষ্ণা বসাক

দিনটা ছিল এই বছরেরই ২১ মার্চ, বিশ্ব কবিতা দিবস। যাওয়ার কথা ইন্দুমতী সভাগৃহে, কবিতা পড়তে। যাওয়া হল না। সাউথ সিটি মলের পাশের গলিতে একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন নার্সিংহোম আমাকে টেনে নিয়ে চলল। টিপ টিপ ঝরা বসন্তের অকাল বৃষ্টির মধ্যে সেই নার্সিংহোমে ঢুকে পড়লাম, এখানে যে ভর্তি আছেন আমার প্রণম্য লেখক প্রফুল্ল রায়।

প্রায় দু’দশকেরও আগে কলকাতা বইমেলায় একুশ শতকের স্টলে তাঁকে প্রথম দেখি। সাদা ধুতিপাঞ্জাবিতে নায়কোচিত চেহারা। সম্ভবত শচীন দাশ আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। প্রফুল্লদা বলেছিলেন ‘ও তুমিই তৃষ্ণা বসাক! তুমি তো অত্যন্ত পাওয়ারফুল লেখক। তোমার সংখ্যালঘু গল্প পড়েছি। অসাধারণ গল্প।’

সেই সময়ে গল্প লিখছি সবে। সংখ্যালঘু গল্পটি বেরিয়েছিল একটি লিটল ম্যাগাজিনে, তা কী করে পড়লেন অত বিখ্যাত এবং ব্যস্ত একজন অগ্রজ লেখক, তা জেনে বিস্মিত হয়েছিলাম। তাঁর মুখের ওই একটি বাক্য আমার কথাজীবনের আত্মবিশ্বাস নির্মাণে সাহায্য করেছে। অথচ তারপর থেকে অনেক অনেক বছর তাঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না আমার, শুধু মনের মধ্যে ভরসা ছিল এই ছাতাহীন প্রান্তিক লেখকের- প্রফুল্লদা আছেন কোথাও।

এর বহু পরে, অল্প কয়েক বছর আগে, তাঁর বাড়িতে যাই শুভঙ্কর গুহ দাদার সঙ্গে। তাঁর প্রথম যে লেখা পড়েছি তা হচ্ছে ‘আমাকে দেখুন’। তখন নেহাতই বালখিল্য বয়স। ক্লাস ফাইভ বা সিক্স হয়তো। সেই বয়সে যেমন লুকিয়ে বিশ্বের নিষিদ্ধ উপন্যাস লোলিতা পড়া হয়ে গেছে, তেমনি ভাবেই পড়েছি আমাকে দেখুন। পুজো বা গ্রীষ্মের ছুটিতে মামাবাড়ি গিয়ে দাদুর নবকল্লোল চুরি করে পড়া। প্রায় কিছুই বুঝছি না, কিন্তু বড়দের লুকিয়ে বড়দের জগতে ঢুকে পড়ার আনন্দ পাচ্ছিলাম ষোলো আনা। পরে প্রফুল্লদার নিজের মুখেই শুনেছি, ওই উপন্যাসটির জন্যে তিনি নাকি বিমল করের কাছে বকুনি খেয়েছেন। একটা কথা ওই বুঝেছিলাম, পাঠককে টেনে নিয়ে যাবার জাদু ক্ষমতা এই লেখকের আছে।

একজন লেখক অনেক লিখলেও একটি বা দুটি রচনায় কাল অতিক্রমের স্থায়ী সিলমোহর পড়ে যায়। প্রফুল্ল রায়ের ক্ষেত্রে সেটি নিঃসন্দেহে কেয়াপাতার নৌকো। দেশ ভাগের যন্ত্রণা নিয়ে বাংলা ভাষায় যে কতিপয় সার্থক উপন্যাস লেখা হয়েছে এটি তার অন্যতম। এর ভূমিকাংশে লেখক জানিয়েছেন, ‘দেশভাগের কারণে জন্মভূমি থেকে আমাকে উৎখাত হয়ে চলে আসতে হয়। দেশ হারানোর সেই যন্ত্রণা আমি চিরকাল ভোগ করে এসেছি।’

আমার লেখক জীবনে ‘চরের মানুষ’ একমাত্র উপন্যাস, যা বই হবার আগে আমি পাণ্ডুলিপির প্রিন্ট আউট কাউকে পড়তে দিয়েছিলাম। চরের মানুষ উৎসর্গ করা তাঁকেই। কেয়াপাতার নৌকোর লেখককে ছাড়া এই বই কাকেই বা উৎসর্গ করা যেত? দেশভাগের যন্ত্রণা না পাওয়া এদেশি ঘটি পরিবারের একটি মেয়ে কীভাবে এই লেখা লিখল তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।

তাঁর আজাদগড় পোস্ট অফিসের পেছনের হেমন্ত অ্যাপার্টমেন্টের চারতলা বেয়ে ওঠার সময় দম ফুরোতে ফুরোতে প্রতিবারই ভেবেছি এই সিঁড়ি ভেঙেই তিনি বাজার, ব্যাংক করে থাকেন। তাঁর সুঠাম চেহারা, বলিষ্ঠ কব্জি বলে দিত, কথাসাহিত্য শৌখিন কাজ নয়, শারীরিক সক্ষমতা প্রচুর লাগে একজন কথাকারের। তাঁর কাছে গেলে, আমরা ফেরার জন্যে উঠে পড়ছি, তবু তাঁর গল্প শেষ হচ্ছে না। বম্বের মাফিয়াদের সঙ্গে সাক্ষাৎ থেকে কলকাতার সেই সময়ের সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের ইনসাইড স্টোরি- তাঁর ঝুলিতে কত যে গল্প ছিল।

তাঁর উপন্যাস পাঠকপ্রিয় হলেও আমার পক্ষপাত থাকবে তাঁর অসামান্য গল্পগুলির দিকে। ‘বর্ষার একদিন’, ‘সাতঘরিয়া শেষযাত্রা’, ‘জাহান্নামের গাড়ি’, ‘রাজা আসে, রাজা যায়’, ‘চোর’, ‘বাঘ’- কত নাম করব? – মুম্বই, উত্তর বিহার, কলকাতা, বাংলাদেশ- প্রফুল্ল রায়ের গল্পের ভূগোল অনেক বিস্তৃত। ওই তো দেখছি রুক্ষ পাথুরে পথে ঝঁা ঝঁা রোদ মাথায় নিয়ে হেঁটে চলেছে সাতঘরিয়া (গল্প সাতঘরিয়া) দিনমজুরির সন্ধানে। নিজের ভাত নিজে জোটাবে এই শর্তে বিয়ে হয় তার, সাত সাত বার। কাজ চলে গেলে বরও চলে যায়।

কিংবা শেষ পারানি গল্পের এক নষ্ট মেয়ে বলে ওঠে, ‘ভগমান আমাদের দিয়েচেটা কী? এই লরকের জঞ্জালে ছুঁড়ে দিয়েচে। লরকেই য্যাখন এসেছি, ত্যাখন এখেনকার মতোই চলব।’

কিংবা কে ভুলবে বর্ষার একদিন গল্পের নাথুনিকে, যে বলেছিল ‘নাহয় আরেকটা দিন ভুখা থাকব। তবুও তো দুটো বুঢ়া বুঢ়ীকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছি কী বল?’

সেদিন সেই মন দমে যাওয়া পরিবেশে বিছানায় অর্ধশোয়া প্রফুল্লদা প্রথমে আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলছিলেন, তারপর চিনতে পারলেন। ফোল্ডিং টেবিলে একটা কলম।

-লিখছেন তো?

বললেন ‘বাড়ি ফিরতে হবে, অনেক লেখা বাকি পুজোর।’ আমি চকোলেট নিয়ে গেছিলাম, নিলেন না, আস্তে আস্তে পথে কুড়োনো একটা মুচকুন্দ ফুল ব্যাগ থেকে বের করে তাঁর কলমের পাশে রেখে চলে আসি।

–এখনই যাবে? সাবধানে যেও।
সাহিত্যের এখনকার ছিন্নভিন্ন ক্লিন্ন জগৎ সেই অদৃশ্য অভিভাবককে চিরদিনের মতো হারাল।

The publish এখনও যাবে? সাবধানে যেও! appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *