এক হুংকার ও শিলিগুড়ির মেয়রকে এক চিঠি

এক হুংকার ও শিলিগুড়ির মেয়রকে এক চিঠি

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


রূপায়ণ ভট্টাচার্য

দুপুর শেষ হয়ে আসার মুখে আপনার বাড়ির সামনে দিয়ে হলুদ স্কুল বাসগুলো যায়। সন্তানকে নেবেন বলে দাঁড়িয়ে থাকেন কোনও মা। তখনই হয়তো আপনাদের পাড়ার কৃষ্ণচূড়া, জারুল, পেয়ারা, রাধাচূড়ার ছায়া মাড়িয়ে চার তরুণী যাচ্ছেন নানা ভঙ্গিতে। প্রতিদিনের ছবি।

পারলে তাঁদের একবার একটা প্রশ্ন করবেন মাননীয়েষু গৌতম দেব। এই যে সেদিন সবুজ জামা পরে আপনারই পুরসভার মেয়র ইন কাউন্সিল অসভ্যের মতো জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের অফিসে অকারণ তারস্বরে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন, সেটা কেমন লেগেছে? কোনও সাধারণ শিক্ষক এমন করলে সাসপেন্ড হতেন না? তবু ভালো, কী ভাগ্যি শিলিগুড়ির, এবার সবুজ শার্ট আগের বারের মতো থুতু ছেটাননি।

এভাবেই কি বাড়িতে কথা বলার শিক্ষা দেওয়া উচিত? বা স্কুলে?

ঔদ্ধত্যের শেষ বাক্য হয়ে দাঁড়ানো ওই শর্মা আসলে কে? সবুজ ফুলশার্টের নাম রঞ্জন শীলশর্মা। আপনাদের শহরে কত ভোট ওই অসভ্যতার জন্য কমল বলতে পারব না। তবে রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোট কিছু কমতে বাধ্য ওই শর্মার জন্য। সরকারি অফিসারদের অপমান করার এ ধরনের ঔদ্ধত্য এঁরা কোথায় পান, শহরের মহানাগরিক? প্রকাশ্যে সবুজ শার্টকে তীব্র ভর্ৎসনা কি করা উচিত ছিল না আপনার? এরপর যদি একজন প্রাথমিক শিক্ষক আপনার চেম্বারে ঢুকেও তুলে নিয়ে যাওয়ার তর্জনগর্জন করে, সেটা কি মানতে পারবেন মহাশয়?

মাসকয়েক আগে গজলডোবার জমি দুর্নীতি নিয়ে লেখালেখির সময়, এই নামটি উঠেছিল অনেক শর্মার সঙ্গে। আপনি তো মেয়র মশাই সেবারও কিছু করেননি। কোনও ব্যবস্থা? না। কোনও প্রকাশ্য ভর্ৎসনা? না। তা হলে আপনি কী বার্তাটি দিলেন আপনার অন্য দুর্নীতিগ্রস্ত পারিষদদের জন্য? চালিয়ে খেলো!

আপনার মেয়র পারিষদদের মধ্যে অনেকেই চালিয়ে খেলায় শুভমান গিল। রত্ন। হিরের রত্ন।

এক রত্ন অসংখ্য বেআইনি নির্মাণের পিছনে। এক রত্ন গ্রামের পঞ্চায়েতের মতো– স্ত্রী কাউন্সিলার, অথচ পিছন থেকে চালান স্বামী। অন্তত পাঁচজনের সম্পত্তির এত বাড়ন্ত, চোখে লাগে। এক রত্ন নিজের নামে বেআইনি কলোনি বানিয়ে ফেলেছেন জীবদ্দশায়। মহানন্দাতীরে বেআইনি জমিকে আইনি করে দেন এক ছুমন্তরে। বাংলায় এমন মন্ত্রোচ্চারণের লোক পাওয়া কঠিন।

অনেকে বাইরে রবিন হুডের ইমেজ রেখে ভিতরে দুর্নীতির মন্দিরের প্রধান পূজারি। অনেকে পারলে নদী বা জঙ্গলই খাবলে দখল করে নেন। এই নগরীতে সাতটি নদী, ভারতের কোনও নগরে নেই। একটা নদী থাকলেই শহরের সৌন্দর্য কত পালটে যায়। আর আমরা সপ্তনদী পেয়েও কিছুই করলাম না গোরু, মহিষের চারণভূমি তৈরি ছাড়া। রাস্তার যে গাছগুলো উপড়ে নিয়ে অন্যত্র লাগানো হল, সেগুলোর খোঁজখবর হয় তো?

মান্যবর মেয়র, আপনার সঙ্গীসাথিদের একজনেরও অভিনব কোনও ভাবনার ছাপ নেই, যা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে শহরের রূপটানে। ক’দিন আগে সিকিমের জোরথাংয়ে গিয়ে শিলিগুড়ির জন্য মারাত্মক কষ্ট হল। আয়তন, লোকসংখ্যার বিচারে জোরথাং সে রাজ্যের চার নম্বর শহর হবে। শিলিগুড়ি তো বাংলার দু’নম্বর। জোরথাংয়ে বড় বাজারটাকে একেবারে চতুষ্কোণ বানিয়ে দোকানগুলোকে জ্যামিতিক মাত্রা দেওয়া হয়েছে। সব রাস্তা কংক্রিটে বাঁধানো। বসার ও হাঁটার অফুরন্ত জায়গা। দোকানগুলো দেখতেও অসামান্য। সাধারণ ভাবনাই অসাধারণ মাত্রা পেয়েছে।

এমন ছবি আমরা কি বিধান মার্কেট, হংকং মার্কেট চত্বরে তৈরি করতে পারতাম না মেয়র মশাই? কতবার যে আপনি ও সৌরভ চক্রবর্তী ওখানে গিয়ে নাটক করে এলেন, সাংবাদিকরা পর্যন্ত ভুলে গিয়েছেন। আপনাদের প্রতিশ্রুতিগুলো গোষ্ঠ পালের মূর্তির পায়ে গড়াগড়ি খেয়ে চলেছে। চিনের প্রাচীর গোষ্ঠবাবু এবার স্বপ্নে জানতে চাইতে পারেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের খোলনলচে পালটানোর কী হল রে বাপু?

আপনার পাড়ার মোড়ে জারুল গাছে বেগুনি ফুল এসেছে। তার নীচেই রিকশাস্ট্যান্ড। সেখানকার কোনও রিকশাচালককে জিজ্ঞাসা করুন। অথবা আপনার বাড়ি থেকে এগিয়ে হাকিমপাড়া গার্লস স্কুলের সামনে রাস্তায় বসা অপেক্ষারত অভিভাবকদের। তাঁরা সবাই হাসবেন মার্কেট, জ্যামজট নিয়ে প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি শুনে। বাই দ্য ওয়ে, শহরের নতুন বাসস্ট্যান্ডটার ভবিষ্যৎ যেন কী হল স্যর?

মান্যবর মেয়র, কষ্টও হয় আপনাকে দেখে। কী সব অর্থ বুভুক্ষু লোকদের নিয়ে কাজ করতে হয় আপনাকে! কেউ জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে গাড়ির ট্রিপের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছেন বুদ্ধি করে। কেউ পেট্রোল ভরানোর নামে রোজগারে ওস্তাদো কা ওস্তাদ। অভয় দেন তো আরও বলি! ওষুধ কেনার সময়ও দুধে জল মেশানোর খেলা হয়। নিন্দুকরা বলে, রাস্তাতেই হাপিস হয়ে যায় কিছু ওষুধ।

সম্মাননীয় মহানাগরিক, আপনার এ শহরে কেউ রাস্তার লাইটের বালব নিয়েও দুর্নীতি করে নমস্য ধান্দাবাজ মহলে। বেআইনি নির্মাণ চলে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। এক এক জায়গায় এক এক নেতা হিরো। তাঁকে ধরলেই দুর্নীতিবাজদের মুশকিল আসান।

বিশ্বাস করুন, আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে সেদিন হাঁটছি। হঠাৎই পিছন থেকে শুনলাম, এক সাইকেল আরোহী তরুণ হাঁটতে হাঁটতে নিজেকেই বলছেন, ‘বাবা-মার কথা শুনে পড়াশোনা করলে আজ এই কাজ করতে হত না।’ জিজ্ঞেস করে বুঝি, এই কাজ মানে ডিস্ট্রিবিউটারের কাজ। সাইকেলে দুটি বড় বাক্স। সাইকেল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ঘুরতে হয় পুরো শহর।

এ শহর পারল না তাকে বা তাদেরকে অন্য আলোর সন্ধান দিতে?

কর্পোরেশনে টেলিফোনে সপ্তাহান্তে আপনি অনেক প্রতিশ্রুতি দেন। সে তো দিতে পারেনই। রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতি দেন সব দলের নেতারা। আপনার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার কোনও প্রতিশ্রুতি দিলে তার অনেক কিছু রাখার চেষ্টা করেন। আপনার মধ্যে সেটা কিন্তু দেখিনি। এই তো ফুলবাড়ি, গজলডোবার বেআইনি জমি কেলেঙ্কারি, মহানন্দা-বালাসনের বালি-পাথর চুরি, শহরের জলকষ্ট, ধোঁয়া নিয়ে কত কথা শুনলাম। সবই অজান্তে আপনার রবীন্দ্রসংগীত হয়ে গেল। সে গান আপনি অবশ্য মঞ্চে গান না-‘কিছুই তো হল না। / সেই সব–সেই সব–সেই হাহাকাররব,/সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা।’

আপনার বাড়ির গেটে দ্বাররক্ষীর মতো দুই পাইন দাঁড়িয়ে। রাস্তার উলটোদিকেই প্রাচীন শিশু বৃক্ষ। সে বৃক্ষ তার গুঁড়িতে বয়ে বেড়ায় অসংখ্য ফার্ন। আলোর খোঁজে সে গাছ নিজেই অদ্ভুতভাবে বেঁকে আকাশ দেখার চেষ্টায়। ছায়ার মাঝেই কত আলো! আপনিও এতরকম উদ্ধত, দুর্নীতিগ্রস্ত, প্রতিবন্ধী কাউন্সিলারের দলবলকে উপেক্ষা করে নিজে আলোর খোঁজে যেতে পারেন না?

আমরা কিন্তু আপনার আমলে এখনও এমন কোনও কাজ দেখলাম না, যা শিলিগুড়ির ইতিহাস মনে রেখে দেবে। ভালো থাকুন স্যর।

আলোয় থাকুন, আলোয় রাখুন।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *