- কৌশিক দাম
জলপাইগুড়ি শহরের অনেক অধঃপতনের মতো আর একটা পতনের দিক হল, প্রায় প্রতি বছর মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে ফলাফল খারাপ হওয়া। আরও সোজা করে বললে রাজ্যের মধ্যে লাস্ট হওয়া। এবার প্রশ্ন, এটা কি আদৌ জেলার সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার হালহকিকত?
আসলে কয়েকটা জিনিস আমরা নিজেরাও মানতে চাই না। আর চাইলেও বুঝতে চাই না। এ শহরের ভেতর ভেতর অনেক পরিবর্তন এসেছে, যুগের হাওয়ায় পালটেছে আর্থসামাজিক পরিস্থিতি। এই তো ক’দিন আগে শহরের ব্যবসা হত মেরেকেটে ১০ তারিখ পর্যন্ত। দিনবাজার, কদমতলা, কামারপাড়ার দোকানিরা তাঁদের জামাকাপড় আনতেন ক্রেতাদের মাথায় রেখে। বাড়তি এনে লাভ নেই জানতেন। শহরের সব মানুষ সবাইকে চেনেন, কার কত বেতন হতে পারে, সেটাও জানা পাড়ার মুদি থেকে স্টেশন বাজারের মাছ বিক্রেতার। এভাবেই চলেছে পুরো শহর।
আর আজকে একবার কদমতলা দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যায়, ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মন ভালো করতে ব্র্যান্ডেড জামা, জুতো নিয়ে আর মোমো-বিরিয়ানি খেয়ে বাড়ি ফিরছে। টাকা এসেছে অনেক। অবশ্য তা জমানোর জন্য নয়, উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। শহরজুড়ে অনেক অনেক নতুন মানুষের বসত হয়েছে, চারদিকে গজিয়ে উঠেছে ফ্ল্যাট।
এগুলো তো ভালো কথা, তাহলে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফল খারাপ কেন? উত্তর হল, খারাপ হয়নি তো। ইংরেজি বোর্ডগুলোর ফলাফল দেখুন। আসল সত্য, এই শহরের জন্য জেলার রেজাল্ট ভালো হত। শহরের কয়েকটা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্ভর করে। তাদের মেধাতালিকায় অবস্থানে ঢাকা পড়ে যেত জেলার বাকি এলাকার দৈন্য। অবশ্য এর কয়েকটা ব্যতিক্রমও ছিল।
এখন সেই নিম্নমধ্যবিত্ত, সরকারি চাকুরেরা হাতেগোনা জলপাইগুড়িতে। আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও যুগের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে শহরের ভালো বাংলামাধ্যমের স্কুলে তাঁদের বাচ্চাদের পড়ান না। কেন পড়ান না, তার অনেক কারণ। প্রধান কারণ, বেশ কয়েক বছর শহরের দুটো স্কুলে লটারির মাধ্যমে ভর্তির কারণে। আবার ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, এইসব ভালো স্কুলে বেশিরভাগ শিক্ষকই ছিলেন শহরের আদি বাসিন্দা। তাঁদের স্কুলের প্রতি ভালোবাসার জায়গা অন্যরকম ছিল।
ইংরেজি বলতে পারা এখন একটা অন্যতম প্রধান আকর্ষণ এবং প্রয়োজনীয় তো বটেই। অনেক নতুন নতুন পেশায় ইংরেজি জানা আর বলা আসল বিবেচ্য বিষয়। তাই শহরে এত ইংরেজিমাধ্যম স্কুল এবং তাদের কলেবর দিন-দিন বেড়েই চলেছে। সব স্কুলেরই খুব ভালো রেজাল্ট হচ্ছে, ভালো ফল করা ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক কিন্তু মধ্যবিত্ত চাকুরে। যাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য সময় দেন আর রোজগারের একটা সিংহভাগ খরচ করেন তাদের শিক্ষার উন্নতির জন্য।
তাই এই শহরে আর রিকশা যেমন ফিরবে না, তেমন বাংলামাধ্যমের ফলও সুদিন দেখবে না। এটাই বাস্তব। অন্য জেলার এই সমস্যা আছে, তবে এত প্রকট নয়। এখানে চা বাগানের বিশাল অঞ্চল রয়েছে। তারা উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক পড়ে বেশির ভাগ। ফল ভালো হয় না। তার প্রভাব পড়ে জেলায়। শহরের ছাপোষা মানুষ চিরকাল চেয়ে এসেছে তার সন্তান সেরা সুযোগ পাক, আর তাই এখনও শহরে এত বড় বড় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসার। এই শহরের জিনে আছে শিক্ষা। এবং শিক্ষার পরিবেশ যেখানে যখন পাওয়া যাবে, সেখানে ভিড় বাড়বেই।
(লেখক শিক্ষক। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা)