অবাক হই! মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভাবি কী করছি নিরন্তর। অনেকেই বলেন, আমি মহান। ভিন্ন পেশায় থেকে সমাজের উপকার করছি। ইতিহাস গড়ছি মহিলা ডোম হিসেবে। এই পেশায় মেয়েদের দেখা না গেলেও আমিই নাকি উদাহরণ! আমিই নাকি দুর্গা! কিন্তু আমার উৎসব? কলম ধরলেন শ্মশানকর্মী টুম্পা দাস।
একের পর এক মৃতদেহ পোড়ার উগ্র গন্ধ সয়ে ফেলেছি। অস্পৃশ্যতা! অবজ্ঞা পেরিয়েও মাঝে মাঝে বড্ড মনখারাপ হয়। পুজো মণ্ডপের পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্র, অথবা হইহুল্লোড়ের মধ্যেও দায়িত্বশীল শ্মশানকর্মী হিসেবে আমাকে মৃতদেহ সৎকারেই ব্যস্ত থাকতে হয়। গত প্রায় একদশক ধরে আমার জীবনে পুজো নেই। ঠাকুর দেখা তো দূর, বহু কারণে ঠিক করে বাড়ির কাছের পুজো প্যান্ডেলেও যেতে পারি না। পুজোয় ব্যস্ত থাকেন বহু মানুষ। আর আমি থাকি বৈদ্যুতিন চুল্লিতে শবদেহ প্রবেশ করাতে। যখন মা দুর্গার মুখ দেখছেন সবাই, আমি দেখি একের পর এক মৃত মানুষ! কারও বয়স কম। কেউ আবার প্রবীণ। আর মন্ত্রের শব্দ ঢাকে মানুষের হাহাকার, প্রিয়জন হারানোর কান্নার শব্দে। খারাপ লাগে। উৎসবে আমি নেই তাই। আবার অস্বস্তি হয়, আমার না হয় উৎসব নেই, কিন্তু যে মানুষগুলো এভাবে প্রিয়জন হারালেন, ওঁরা বাঁচবেন কীভাবে! পেটের টানে যে পেশায় আসা, সেই পেশাতেই এত বৈচিত্র্য দেখি রোজ। হয়তো মা দুর্গার দশহাতের মতো।
মহাষ্টমী তো দূর, পুষ্পাঞ্জলি যে কবে দিয়েছি জানি না। খুব বেশি হলে দূর থেকে মায়ের মুখটা দেখি। আগে কাঠের চিতায় কাজের সময় ২৪ ঘণ্টা সময় পেতাম না। এখন বৈদ্যুতিন চুল্লি চলে ১২ ঘণ্টা। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করি। তবুও সতর্ক থাকতে হয়। রাতে যদি কিছু আসে! বাড়ি ফিরে আর সারাদিনের ধকলের পর উৎসবে মাতি না। ঘর থেকে প্রণাম করি মাকে। হয়তো অষ্টমীর দিন একটু সময় পেলাম, তাও বাড়ির খুব কাছের কোনও মণ্ডপে।
মা দুর্গা আমার জীবনে লড়াই দিয়েছেন রোজ। বাবা চলে যাওয়ার পর সংসার চালানোর তাগিদে তাঁর পেশা আঁকড়ে নিলাম। ডোম হলাম আমি। মহিলা ডোম। আর কোথায় কে আছেন এই রাজ্যে জানি না! অনেকেই কুদৃষ্টিতে দেখলেন। কেউ বললেন, এটা তো পুরুষের কাজ, তুমি কেন! কেউ ভালোবেসে বোঝালেন। প্রায় সকলেই বললেন হেরে যাও। অন্য কাজ করো। এসব তোমার জন্য নয়। কাঠের চিতা সাজাতে পারব না আমি! সারাদিন ভয় পেয়েছি। মায়ের কাছে বসেছি। ভেবেছি হয়তো ছেড়ে দিতে হবে এই কাজ। কিন্তু হেরে যাইনি। মা দুর্গা যদি অসুর বিনাশ করতে পারেন, তাহলে আমি কেন বাধা জয় করতে পারব না? কেন ভিন্ন পেশার সাহস নিয়েও লড়াই করতে পারব না?
পুজোয় তো বটেই, জাতিগত বৈষম্য, বিড়ম্বনা বাড়িয়েছে বহুবার। কারণ, আমার পেশা! এমন একটা সময় দেখেছি, আমি এই কাজ করি বলে আমাদের বাড়ির কাছ থেকে কেউ যেতেন না, অন্য রাস্তা ব্যবহার করতেন বহু মানুষ, যদি কাউকে ছুঁয়ে ফেলি আমরা। এমনকি শ্মশানে যাঁরা আসতেন, তাঁরাও মৃতদেহ আমি কীভাবে সৎকার করব, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন রোজ! তবুও পেরেছি। লড়াই করেছি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরের পুরন্দরপুর শ্মশানে বসেই তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সেই বাপির মেয়ে টুম্পা ডোম আজ অনেক কাজে ব্যস্ত!
তবুও মনখারাপ হয়! উৎসব, পুজো, নতুন জামা, হরেকরকম খাবারের ভিড়েও আমি একাকী! শ্মশানে ভিড় সরে যাওয়ার পরে নিস্তব্ধতা গ্রাস করে আমাকেও। সংসারের সুখ পাইনি। দুঃখ পাই না আর! অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, কিন্তু কেউ ঘরে তোলেননি। যে শুনতেন মেয়ে ডোম, পালিয়ে গিয়েছেন সকলেই! স্ত্রীর মর্যাদা পাইনি। সমাজ, আত্মীয়, কেউ সেইভাবে গ্রহণ করেনি আমাকে। বাড়িতে মা রয়েছেন। তাঁর জন্য সব। কাজ করি। আয় করি।
জীবনকে নিজের মতো করে চালাই আজও। পুজোয় মাংস খাই, মিষ্টি আসে। পরিবারের সকলের জন্য নতুন পোশাক হয়। সংসারে কষ্ট হয়তো কমেছে। হয়তো প্রকাশ্য আনন্দ কমেনি একটুও। কিন্তু তথাকথিত সুশীল সমাজের কাছে টুম্পা আজও লড়াকু নারী হয়তো যেন অচ্ছুৎ! সে যেন এযুগের দুর্গা নন, রয়ে গিয়েছেন শুধুমাত্র ডোম হিসেবেই!
অনুলিখন: রমেন দাস।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন