অর্ণব আইচ ও নিরুফা খাতুন: ‘‘ইশ্বরের দেওয়া প্রাণ। আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলে যাব। স্বেচ্ছায় আমরা মৃত্যুবরণ করলাম।’’ কসবায় একই পরিবারের তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় সুইসাইড নোট উদ্ধার পুলিশের। তদন্তকারীদের প্রাথমিক ধারণা, আর্থিক অনটন ও দেনার দায়েই আত্মঘাতী হয়েছেন কসবার বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁদের বিশেষভাবে সক্ষম ছেলে।
সকাল থেকেই কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁদের ছেলের। ফ্ল্যাটের দরজাও ভিতর থেকে বন্ধ। তাতেই সন্দেহ হয় প্রতিবেশীদের। তাঁদের কাছ থেকেই খবর পেয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফ্ল্যাটে আসে দক্ষিণ কলকাতার কসবা থানার পুলিশ। কোলাপসিবল গেট ও দরজার লক ভেঙে পুলিশ উদ্ধার করে বৃদ্ধ দম্পতি ও তাঁদের ছেলের ঝুলন্ত দেহ। পুলিশ দেখে, বাড়ির কর্তা স্মরজিৎ ভট্টাচার্য (৭০)-র দেহ দড়ি দিয়ে ঝুলছে ডাইনিং রুমের সিলিং থেকে। শোওয়ার ঘরের ভিতরে ঝুলছে বৃদ্ধর স্ত্রী গার্গী ভট্টাচার্য (৬৮) ও ছেলে আয়ুষ্মান ভট্টাচার্য (৩৮)-র দেহ। তিনজনেরই হাতের শিরা কাটা। রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে। মঙ্গলবার কসবার রাজডাঙা গোল্ড পার্কের একটি বহুতলের তিনতলার ফ্ল্যাটে ঘটেছে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি।
ঘরের ভিতর থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে সুইসাইড নোট। তাতে লেখা, ‘‘ইশ্বরের দেওয়া প্রাণ। আমরা ঈশ্বরের সঙ্গে মিলে যাব। স্বেচ্ছায় আমরা মৃত্যুবরণ করলাম।’’ এ ছাড়াও সুইসাইড নোটে বাড়িওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে লেখা, তাঁরা তিন মাসের বাড়ি ভাড়া ও বিদ্যুতের বিল দিতে পারেননি। বাড়ি ভাড়ার আগাম টাকা দেওয়া রয়েছে। তবু বাড়িওয়ালা ভাড়া ও বিল বাবদ হাজার পাঁচেক টাকা পান। ওই টাকা যেন তিনি মকুব করে দেন। একই সঙ্গে তাঁরা বাড়িওয়ালাকে অনুরোধ করেছেন যেন, তিনজনের দেহ ভাল করে সৎকার করা হয়। প্রাথমিক তদন্তে ইঙ্গিত মিলেছে যে, দেনায় ডুবে যাচ্ছিল ওই পরিবার। অর্থনৈতিক সমস্যায় পিঠ ঠেকে গিয়েছিল পরিবারের। সেই কারণেই তিনজন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে ট্যাংরায় এভাবে শিরা কেটে খুন করা হয় পরিবারের দু’জনকে। ফলে এই ক্ষেত্রে তিনজনই নিজেদের হাতের শিরা কাটেন, না কি একজন অন্য দু’জনের শিরা কেটেছেন, তা নিয়ে রয়েছে ধন্দ। তবে পুলিশের মতে, হাতের শিরা কাটার পর তিনজনের মৃত্যু হয়নি। তার পরই তিনজন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। কসবা থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা শুরু হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বৃদ্ধ দম্পতির ছেলে আয়ুষ্মান বিশেষভাবে সক্ষম। তাঁর পায়ে সমস্যা ছিল ও মানসিকভাবেও ছিলেন বিপর্যস্ত। প্রায় আড়াই বছর আগে কসবার ওই ফ্ল্যাটে ভাড়া নেন স্মরজিৎবাবুরা। সোমবার বিকেল পাঁচটার পর থেকে তাঁদের আর দেখা যায়নি। এমনিতেও সন্ধ্যা সাতটার পর তাঁরা বেরতেন না। প্রত্যেকদিন বাবা ও ছেলে জল আনতে যেতেন। কিন্তু এদিন সকালে আনতেও যাননি। এক পরিচারিকাও বেল বাজিয়ে সাড়া না পেয়ে ফিরে যান। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে পুলিশ ফ্ল্যাটে ঢুকে তাঁদের দেহ উদ্ধার করে। স্মরজিৎ একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করতেন। এ ছাড়াও মিউচুয়াল ফান্ডের ব্রোকার ছিলেন তিনি। কিন্তু ব্রোকার হিসাবে বিশেষ টাকাও পাননি। স্ত্রী একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। দু’জন অবসর গ্রহণের পর কিছু টাকা পেলেও ক্রমে তা শেষ হয়ে যায়। তার জন্য টাকা দেনা করা শুরু করলেও তা ফেরত দিতে পারতেন না। ছেলেকে নিয়েও অবসাদে ভুগতেন দম্পতি। ক্রমে দেনার দায়ে ডুবতে শুরু করেন। পাওনাদারের চাপও ছিল। তারই জেরে একসঙ্গে পরিকল্পনা করে আত্মঘাতী হন বলে জানিয়েছে পুলিশ।