গোড়ার দিকে ছিলেন জওহরলাল নেহরু। যেখানে যত গোলমাল সেখানেই নেহরুর দোষ। যত দোষ সব নেহরু। তা সে অর্থনীতি হোক কিংবা বিদেশনীতি, কৃষি হোক বা শিল্প সবেতেই নেহরু। তিনিই যত নষ্টের গোড়া। কয়েক বছর এভাবে কাটিয়ে যখন ঠাহর হল দেখতে দেখতে রাজত্বের এক দশক পেরিয়ে গিয়েছে, লোকে আস্তেধীরে তাদের দিকেও আঙুল তুলছে, তখন আরও পিছনের দিকে এগিয়ে সোজা মোগল আমলে পৌঁছে গিয়েছে বিজেপি।
এখন তাদের চাঁদমারিতে ঔরঙ্গজেব। মাঝের আড়াইশো বছরের ইংরেজ আমল বেমালুম টপকে মোগল আমলের সঙ্গে লড়াই। এটা বেশ নাগপুরের সিলেবাসের সঙ্গে মিলে যায়। মোগল শাসকরা মুসলমান। তারা অত্যাচারী। অতএব ইতিহাসের পাঠ্য থেকে তো বটেই, লোকের স্মৃতি থেকেই মুছে দাও। চার-পাঁচশো বছর আগেকার চরিত্র নিয়ে হল্লা পাকিয়ে এখনকার সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে দাও। আর সংখ্যালঘুদের ভয় পাইয়ে দাও।
তৃতীয়বার গদিতে বসে বিজেপি পুরোপুরি মন দিয়েছে হিন্দুত্বে। যাঁরা মনে করেছিলেন রাম মন্দির হয়ে যাওয়ার পর বিজেপি এবার হিন্দুবাদী ‘কারিয়াক্রমে’ ক্ষান্তি দেবে তাঁরা ডাহা ফেল। তাদের মাথা সতত সচল। মাথা খাটিয়ে নানারকম পন্থা খুঁজে বের করায় নাগপুরের জুড়ি মিলবে না। একটার পর একটা ইস্যু ঝুলি থেকে বেরোতে থেকেছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা রদ করা থেকে তিন তালাক, ওয়াকফ- বলতে গেলে এক হিন্দুরাষ্ট্র বাদে প্রায় সব অ্যাজেন্ডা পুরো হয়েছে। যখন এসব ভেবে মনে করা হচ্ছে অতঃকিম, তখনই আসছে অন্য কিছু।
এবার হিন্দুত্ব এসেছে সনাতনী চেহারায়। আদর্শ হিন্দু বাস করবেন হিন্দু নামের শহরে। মাছমাংস বর্জন করে হবেন শাকাহারি। মদ ছোঁবেন না। নিত্য গঙ্গাস্নান করবেন। যদি কখনও ভেবে থাকেন এইবার হিন্দুত্বের জিগিরে টান পড়তে চলেছে তাঁরা ভুল ভেবেছেন। একদিকে তাদের ‘এক’ তত্ত্ব — এক দেশ, এক নির্বাচন, এক নেতা, এক ধর্ম, এক জীবনযাপন, অন্যদিকে দেশজুড়ে নাম বদলের হিড়িক। যেখানে যত মোগল আমলের শহরের নাম আছে সব বদলে দাও। মুসলিম নাম বদল করে ইতিহাসের শুদ্ধিকরণ চলছে। আগেই যোগীজির রাজ্যে এলাহাবাদ হয়েছে প্রয়াগরাজ, মুঘলসরাই হয়েছে দীনবন্ধু উপাধ্যায় স্টেশন, ফৈজাবাদ মুছে অযোধ্যা, মুস্তাফাবাদ হয়েছে রামপুর, গুরগাঁও গুরুগ্রাম। বিজেপি যেখানে ক্ষমতায় সেখানে একই কায়দা। তাদের মতে, এটা হিন্দুদের সাংস্কৃতিক অতীতকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা। জনগণ এটাই চাইছে।
তবে যোগীজির রাজ্যকে ছাপিয়ে গিয়েছে পুষ্কর সিং ধামির উত্তরাখণ্ড। সে রাজ্যে নাম বদলের হিড়িক অনেক বেশি। ইংরেজ নাম ম্যাকলয়েডগঞ্জ অবিকৃত রয়ে গেলেও রেহাই নেই মহম্মদপুরের। তার নতুন নাম হয়েছে গুরু গোবিন্দ সিং নগর। মহম্মদপুর জাট এখন মোহনপুর জাট। খানপুর কুরসালি হয়েছে আম্বেদকরনগর। ইদ্রিসপুর এখন নন্দপুর, খানপুর শ্রীকৃষ্ণপুর, আকবরপুর ফজলপুর এখন বিজয়নগর। নবাবি রোডের নাম বদলে অটল মার্গ, সুলতানপট্টিনগর পঞ্চায়েতের নতুন নাম কৌশল্যাপুরী। উত্তরাখণ্ডের চার জেলায় অন্তত পনেরো জায়গা বা রাস্তার নাম পালটে গিয়েছে। নাম বদলের উদ্যমে এখন গেরোয় পড়েছেন পুষ্কর।
উত্তরাখণ্ডের মিয়াওয়ালার নাম বদলাতে গিয়ে প্রবল বাধার মুখে পড়েছেন তিনি। নবাব, সুলতানের মতো মিয়াও মুসলিম বলে ধরে নিয়েছিল সে রাজ্যের প্রশাসন। সেখানকার রাজপুতরা বেজায় ক্ষুব্ধ। তাঁরা বলছেন, মিয়াওয়ালা মোটেই মুসলিম নাম নয়। রাজপুতদের উপাধি। গাড়োয়াল, কুমায়ুনের রাজারা মিয়াওয়ালা রাজপুতদের নিয়োগ করতেন কঠিন যুদ্ধ জেতার জন্য। তাঁরা হইচই বাধিয়েছেন। নাম বদল নতুন কিছু নয়। ক্যালকাটাকে কলকাতা, মনুমেন্টকে শহিদ মিনার, ধর্মতলা স্ট্রিটে লেনিন সরণি করা হয়েছে। বিস্তর রাস্তা, পার্কের নামও বদলানো হয়েছে। বিজেপি ক্ষমতায় এসে কলকাতা বন্দরের নাম দিয়েছে শ্যামাপ্রসাদের নামে, চাপা পড়ে গিয়েছে আগের সুভাষচন্দ্র বসুর নাম। তবে বেছে বেছে মোগল বা মুসলিম নামের শহরগঞ্জের নাম বদলানোর এই অভিযান একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন মেনেই। বিশদে বলা নিষ্প্রয়োজন।
যাঁরা ভেবেছিলেন বিজেপি ফুরিয়ে যাবে, তাদের কর্মসূচি একটা সময়ে ফুরিয়ে যাবে, তাঁরা ভুল বুঝেছেন। তাদের আইডিয়ায় টান পড়েনি। আর হাতের পাঁচ পহলগাম তো রইলই।