ইংরাজির নাক কেটে ভারতীয় ভাষার যাত্রাভঙ্গ, কী বললেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?

ইংরাজির নাক কেটে ভারতীয় ভাষার যাত্রাভঙ্গ, কী বললেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?

বৈশিষ্ট্যযুক্ত/FEATURED
Spread the love


ইংরাজি-বলিয়েরা লজ্জিত হবেন, এমন ব্যবস্থা নাকি দ্রুত গড়ে উঠবে বলে দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু এও তো ঠিক, ভারতীয় ইংরেজির একটি নিজস্ব পরিসর গড়ে উঠেছে, তাতে আনন্দিত হওয়ার কথা। আর বৃহত্তর জনসংযোগের প্রশ্নে ইংরাজি জানা বিশেষ দরকার। তাহলে কেন উঁচু-নিচু ভেদ? কেন বিদ্বেষ বপন? লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়।  

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি বই উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের সূত্রে কিছু দিন আগে মন্তব্য করেছেন খুব শীঘ্র এমন ব্যবস্থা এ-দেশে গড়ে উঠবে যাতে শুধু ও মুখ্যত ইংরেজি জানা ভারতীয়রা লজ্জিত বোধ করবেন। কথাটির মধ্যে বাচনভঙ্গির প্রাবল্য ও তীব্রতা ‘ইন্ডিয়া’-র বাসিন্দাদের বিচলিত করবে। অস্বীকার করার উপায় নেই এ-দেশে ‘ইন্ডিয়া’ ও ‘ভারত’ এ-দুয়ের এক বিভাজন বহু দিন ধরেই ক্রমে গড়ে উঠেছে। ‘ইন্ডিয়া’ ইংরেজিমুখী গ্লোবাল, আর ‘ভারত’ তারই ভিতরে লোকাল। এই দুয়ের মধ্যে সখ্য গড়ে উঠলেই দেশের উন্নতি হবে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করলে কিন্তু কিছু হওয়ার নয়।

ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখায় ‘আমরা’ ও ‘তাহারা’ এই দুই দলের বিভাজন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা ছিল– ইংরাজি জানা শ্রেণি ও ইংরাজি না-জানা শ্রেণি দুয়ের মধ্যে ‘দুস্তর পারাবার’। ইংরাজি না-জানা পণ্ডিতরা কীভাবে ইংরেজি বাক্যের বঙ্গানুবাদ করেন, তার নিদর্শন আছে সুকুমার রায়ের নাটক ‘ঝালাপালা’-য়। সেখানে ‘আই গো আপ’ আর ‘উই গো ডাউন’– এই দুই ইংরাজি বাক্যের বঙ্গানুবাদ মনে রাখার মতো। ‘আই গো আপ’ মানে নাকি ‘গরুর চক্ষে জল’। আর ‘উই গো ডাউন’ মানে নাকি ‘গোডাউন’ অর্থাৎ গুদোমখানায় উই লেগেছে। পণ্ডিতমশাই এ-দুয়ের মধ্যে কার্যকারণ সূত্রও স্থাপন করেছিলেন। গুদোমখানায় উই লেগেছে তাই দেখে গরু কঁাদছে। এমন পণ্ডিতি ইংরাজি জ্ঞান দেখলে ‘সাধু সাধু’ বলতে হয়।

অপর পক্ষে ইংরাজি জানা কৃতবিদ্যর বাংলা জ্ঞানও দেখার মতো। সেই বাংলা জ্ঞানের নিদর্শন বঙ্কিমচন্দ্রর ‘লোকরহস্য’ বইয়ের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের আদর’ রচনায় পাওয়া যাবে। সেখানে স্ত্রী
কৃতবিদ্য স্বামীকে বাংলা কবিতার ‘অর্থ’ বোঝাতে বলেছিলেন। তারপর সে এক ভয়ংকর অবস্থা।

উচ্চ। ‘সন্ধ্যা গগনে নিবিড় কালিমা’, তা, ‘নিবিড়’ কাকে বলে?
ভার্য্যা। ও হরি! এই বিদ্যাতে তুমি আমাকে শিখাবে? নিবিড় বলে ঘনকে। এও জান না? তোমার মুখ দেখাতে লজ্জা করে না?
উচ্চ। কি জান-বাঙ্গলা ফাঙ্গলা ও সব ছোট লোকে পড়ে, ও সবের আমাদের মাঝখানে চলন নেই। ও সব কি আমাদের শোভা পায়?
ভার্য্যা। কেন, তোমরা কি?
উচ্চ। আমাদের হলো Polished society– ও সব বাজে লোকে লেখে– বাজে লোকে পড়ে– সাহেব লোকের কাছে ও সবের দর নেই– polished society-তে কি ও সব চলে?

বঙ্কিমচন্দ্র ও সুকুমার রায় যথাক্রমে ইংরাজি জানা কৃতবিদ্য ও শুধু সংস্কৃত জানা পণ্ডিতের ভাষা-দীনতা নিয়ে কৌতুক করার জন্যই এসব লিখেছিলেন। বঙ্কিম ও সুকুমার দু’জনেই কৃতবিদ্য ও একাধিক ভাষায় পারংগম, নিজ ভাষায় সাবলীল। এঁরা দু’জনেই ইংরাজিতেও লিখেছিলেন, ইংরাজি জানার জন্য লজ্জিত হননি। তবে ইংরাজি ভাষা-জ্ঞানকে ভারতীয়ত্বর রূপ দিয়েছিলেন। এর বাইরে অসংখ্য সাধারণ মানুষ থাকতে পারে, যারা কেবল একটি ভারতীয় ভাষাই জানে। একটি ভাষা জানা দোষের নয়। সেই ভারতীয় ভাষাটির মাধ্যমে সে যাতে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে, সে-ব্যবস্থা করা চাই। শুধু কাজই নয়, সে-ভাষার মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থাও বিধেয়।

মনে রাখতে হবে উনিশ-বিশ শতকের ভারতের থেকে একুশ শতকের ভারতের চেহারা আলাদা। উনিশ শতকে ইংরাজি যে-অর্থে ভারতীয় ভাষা হয়ে উঠেছিল, একুশ শতকের ভারতে ইংরাজি তার থেকে অনেক বেশি ভারতীয় ভাষা। একুশ শতকে ‘ইন্ডিয়া’ ও ‘ভারত’– এই দুই ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে যদি সংযোগসাধন করতে হয়, তাহলে স্বীকার করতেই হবে ইংরাজি ভারতীয় ভাষা, মানে, ভারতীয় ইংরাজির, নিজস্ব চরিত্র আছে। সেই ভাষার প্রতি বৈরী মনোভাব তৈরি করলে দুই সংস্কৃতির ভারতীয়দের মধ্যে সংযোগের রাস্তা তৈরি করা কঠিন হবে। যে-ভারতীয়রা মুখ্যত ইংরাজি জানে ও সেই ইংরাজির উপরে নির্ভর করেই জীবনযাপন করে, তাদের দোষারোপ করে কিংবা আলাদা করে দাগিয়ে দিয়ে অন্য ভারতকে তাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তুললে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি।

ইংরাজি জানা দোষের নয়, তবে কেন কীভাবে কী ব্যবস্থাপনায় এই দুই সংস্কৃতির দূরত্ব এ-দেশে গড়ে উঠল, তা যাচাই করা দরকার। সে যাচাইয়ের কাজ যে কখনও হয়নি, তা নয়। বহুবারই হয়েছে। তবু খেয়াল করলে দেখা যাবে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা ইংরাজি ভাষার সঙ্গে বিচিত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

এই দূরত্ব নির্মূল করার জন্য ইংরাজ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে এক সময় বিদ্যালয় স্তরে বঙ্গদেশে বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই ব্যবস্থাপনায় স্বভাষায় বিদ্যালয় স্তরে জ্ঞান অর্জন করা যেত। যে-সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বিদ্যালয় স্তরে বাংলা মাধ্যমের সূত্রপাত প্রায় সেই সময় কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য চন্দননগরে ‘স্বরাজ ইন আইডিয়াজ’ নামের বক্তৃতা দিচ্ছেন। সেই বক্তৃতা নিবন্ধে তিনি ভারতীয়দের ‘প্রকৃত মন’ (actual thoughts/ vernacular thoughts) কীভাবে ‘ছায়াচ্ছন্ন মন’ (shadow thoughts) দ্বারা ঢেকে গেল তার কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন এক নিরুপায় সাংকর্যকে আমরা ভাষা-চিন্তা-সংস্কৃতিতে গ্রহণ করেছি। এই সাংকর্যের কথা যখন কৃষ্ণচন্দ্র বলছিলেন তঁার থেকে সময় ও পরিস্থিতি অগ্রসর হয়েছে নানাভাবে। এই ভাষিক ও সাংস্কৃতিক সাংকর্যকে স্বীকার করাই ভারতীয়দের পক্ষে এখন বিশেষ সামর্থ‌্য হয়ে উঠতে পারে। আর তাতে ইংরাজি ভাষাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে প্রয়োগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই কাজ ব্যাহত হবে যদি ইংরেজিকে বাদ দিয়ে, ইংরেজি জানাকে লজ্জা পাইয়ে দিয়ে গড়ে তোলা হয় সংকীর্ণ কোনও ভারতীয় কক্ষ।

ইংরাজিকে ভারতীয় ভাষা রূপে স্বীকার না-করে, ইংরাজিকে নিতান্ত ‘বিজাতীয়’ ভাষা বলে দাগিয়ে দিয়ে তার পরিবর্তে অন্য কোনও ভারতীয় ভাষার প্রাধান্য ঘোষণা করা কিন্তু খুব কাজের কথা নয়। ভয় হয় ও কোথাও কোথাও কার্যক্ষেত্রে দেখাও যায় যে, এই কাজটিই কৌশলে করা হচ্ছে। ‘এক দেশ এক ভাষা এক ধর্ম’-র স্লোগান ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে ক্ষতিকর ও বিজাতীয়। এক দেশ এক ভাষা এক ধর্ম এই ভাবনাই আসলে পাশ্চাত্যের হাত-ফেরতা হয়ে আমাদের মগজে প্রবেশ করেছে। ভারত এক ভাষার দেশ ছিল না, হিন্দু ধর্মের ছাতাটিও আদি ভারতে একত্বের অহমিকায় প্রবল হয়ে উঠতে পারেনি, সেখানে নানা ধর্ম সম্প্রদায় ও সংস্কৃতির নানা ফের-ফার ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষার আবার অন্যতর এক জগৎ। সব মিলিয়ে বহুধা ও বিচিত্র। সেই বহুধা ও বিচিত্র ভারতের আদর্শ বজায় ছিল বলেই যেভাবে একদা ইসলামের ভারতীয় রূপ গড়ে উঠেছিল, সেভাবেই ক্রমে ইংরাজির ভারতীয় চেহারা তৈরি হয়ে উঠেছিল। ধুতি-চাদর পরা বিদ্যাসাগর অনায়াসে ইংরাজি বলতে-লিখতে পারতেন, সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাব্যবস্থায় কোনওরকম দ্বিধা না-করেই ইংরাজিকে গ্রহণ করেছিলেন।

এই অতীত কথা মনে রাখলে এখনকার ভারতে ইংরাজির প্রতি বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো অর্থহীন। বিভিন্ন প্রদেশে ইংরাজি মাধ্যম বিদ্যালয়-ব্যবস্থার অগ্রগতি কেন হল, তার সমীক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সহযোগী সম্পর্ক তৈরি করা জরুরি। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে যে ভাষাগুলি নানা কারণে পিছিয়ে রয়েছে, সেই ভাষাগুলির জন্য নানারকম প্রযুক্তি-নির্ভর উপকরণ তৈরি করার সরকারি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। কোনও কিছু গড়ে তোলার জন্য ইতিবাচক উপায় স্থির করাই বুদ্ধিমানের কাজ, ‘নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রাভঙ্গ’ করার সংকীর্ণতা দেখানো অনুচিত। ইংরাজির নাক কাটলে এ-দেশে ভারতীয় ভাষারও ‘যাত্রাভঙ্গ’ হতে পারে। ভারত বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ইংরাজি জানা ভারতীয়দের পক্ষে আশীর্বাদ, যা আছে তা নিয়েই যা নেই তার দিকে এগোনো চাই। ভারতীয় ভাষাগুলির মধ্যে সহযোগের সম্পর্ক তৈরি করা ও ইংরাজিকে ভারতীয় ভাষা হিসাবে মেনে নিয়ে এই সহযোগী সম্বন্ধের উঠোনে টেনে আনাই এখন উপায়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক অধ্যাপক,
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
biswajitray1978@yahoo.com



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *