- পিসি সরকার জুনিয়ার
প্রায় ২০০ বছর আগে এক নামী বিজ্ঞানী যখন স্টিম ইঞ্জিন বানিয়ে চালিয়ে দেখালেন, তখন সব্বাই সেই সৃষ্টিকে তারিফ করলেও পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক মহলের একাংশ খুব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘ইস, বিজ্ঞান এবার ফুরিয়ে গেল, নতুন করে আবিষ্কার করার কিছু আর রইল না।’ ওদিকে আমাদের দেশে একসময় ‘যন্ত্রমাত্রিকা’ বলে একশ্রেণির শিল্পের প্রচলন ছিল। ৬৪ কলার এক বিশেষ এবং প্রধান কলা ছিল ওই ‘যন্ত্রমাত্রিকা শিল্প’।
আমরা সেসব কথা ভুলে গিয়েছি। রাজা ভোজ এই ব্যাপারে একটা বইও লিখেছিলেন। তাতে জমিতে ইঞ্জিন কেন, আকাশে ওড়ার বিমানের ইঞ্জিনের কৌশলও শেখানো ছিল। বইটা ছিল দু’ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে ছিল- বিমানের বিবরণ আর আসল, কীভাবে তৈরি করা হবে তার বর্ণনা। বইটা পাওয়া গিয়েছে। রয়েছে বিলেতের লাইব্রেরিতে। কিন্তু কী দুঃখের ব্যাপার, দ্বিতীয় অংশটা কে বা কারা যেন ছিঁড়ে ফেলেছে। তারপর বহু যুগ কেটে গেছে, বহু বিদেশি সভ্যতার আঘাতও সয়েছে আমাদের বিদ্যেবুদ্ধি এবং সব কিছু। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রাখা লাইব্রেরির পুঁথিপত্র বাইরে নিয়ে এসে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন সেখানকার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছিল। পাণ্ডুলিপির পাহাড়, মানে পুঁথিগত বিদ্যার পরিমাণ ছিল এতই বিশাল যে সেই আগুন জ্বলেছিল এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। ঘোষিত হয়েছিল, ওগুলো সব শয়তানের শিক্ষা।
শুধু নালন্দা কেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গাতেও ঘটেছিল ঠিক একই ঘটনা। মুনি-ঋষিদের দেওয়া শিক্ষা করে দেওয়া হয়েছিল ‘বন্ধ’!
এভাবেই হয়েছিল আমাদের শিক্ষার ধারাকে স্তব্ধ করা। রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল ‘ওগুলো ফালতু শিক্ষা, অকেজো।’ আমরা নাকি সেই স্টিফেনসন সাহেবের তৈরি ইঞ্জিনের রেলগাড়িকে সশব্দে চলতে দেখে সেটাকে অপদেবতা ভেবে পুজোআর্চা ধূপধুনো দিয়ে তুষ্ট রেখে বিপদ-আপদের হাত থেকে রক্ষা পেতে শুরু করে ছিলাম। মিথ্যে কথা। ভুল কথা। ওরা নিজেদেরকে প্রগতিশীল প্রমাণ করতে অন্যকে ছোট করার রেওয়াজ ওদেশের প্রায় সবার আছে। না জেনে, না বুঝে আনতাবড়ি একটা সমালোচনা করলেই হল। এতে প্রমাণ হচ্ছে ওঁরা বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকলেও প্রকৃতির রূপ রস গন্ধকে তাঁরা সমঝে উঠতে বা সহ্য করে উঠতে পারেননি।
“গুড মর্নিং” তোমরা বলো কেন? না বললে কি আর সময়টা শুভ হত না? কবিগুরু বলেছেন, “শুভকর্ম পথে, ধরো নির্ভয় তান…”। এই ‘নির্ভয় তান’ কি কুসংস্কারের চিহ্ন? আর কিছু না হলেও, ওঁরা যে হৃদয় দিয়ে প্রকৃতির সুর, ছন্দ, লয় ইত্যাদি শুনতেই পান না, তা বোঝা গেল। আমার মনে হয় ওঁরা বোধহয় বিশ্বকর্মাপুজো বা ‘শুভযাত্রার’ জন্য স্বস্তি মন্ত্র- শাঁখ বাজানো, উলুধ্বনী বা বিঘ্ননাশিনী পুজোর জন্য আয়োজন এবং পুজোপাঠের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন। ওদের বোঝাতে হবে, যাত্রা শুভর জন্য পুজো, প্রার্থনা বা নারকেল ফাটানো ঠিক ওদের বিশাল আধুনিক জাহাজকে সাগরের জলে ভাসিয়ে যাত্রা শুরু করার সময় কোনও এক নামকরা বিজ্ঞ ব্যক্তিকে দিয়ে ওঁরা যেমন শ্যাম্পেনের বোতল জাহাজের গায়ে ভেঙে যাত্রা শুরুর মুহূর্তটাকে উৎসব করেন, এটা ঠিক তারই এক ভারতীয় সংস্করণ।
পাশ্চাত্যের পণ্ডিতেরা ভাবেন মানুষ দুনিয়াকে জানছে বুঝছে পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। দেখা, শোনা, শোঁকা, ছোঁয়া আর স্বাদ দিয়ে। ঠিক কথা কিন্তু পুরোটা ঠিক নয়, আরেকটা ওদের অনেক আগের থেকে আমাদের দেশের মুনিঋষিরা এসব নিয়ে বহু আগেই আলোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন- ইন্দ্রিয় শুধু ওই পাঁচটা নয়। এই পাঁচটাকে তাঁরা নাম দিয়েছেন ‘কর্মেন্দ্রিয়’। কিন্তু এই কর্মেন্দ্রিয় বাদ দিয়েও আরও অনেক ইন্দ্রিয় আছে। লম্বা সেই ফিরিস্তি এবং তা নিয়ে আলোচনা করার জায়গা এটা নয়। তবু আলোচনার তাগিদে আর পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের কথা তাঁরা আলোচনা করে গেছেন সেগুলোকে বাদ দিলে বাঁচা অনর্থক। এই কর্মেন্দ্রিয় পাঁচটার বাইরে আরও ইন্দ্রিয় আছে, তাকে বলা হয় ‘জ্ঞানেন্দ্রিয়’। এই জ্ঞানেন্দ্রিয়র বাইরেও যে আর ইন্দ্রিয় নেই তা কিন্তু নয়। সেগুলো হল- মন, চিন্তা, অভিজ্ঞতা, বিবেক এবং যুক্তি। এই তালিকা অফুরন্ত, পেঁয়াজের খোসার মতো স্তরের পর স্তর দিয়ে তৈরি এক অনন্তের পর অন্য এক অনন্ত- এই আলোচনা বা এর গঠন বৈচিত্র্য সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝার নয়।
এই কথাগুলো আমি লিখলাম, তার সঙ্গে পরবর্তী কাহিনীর যে সরাসরি একটা যোগাযোগ আছে তা নয়। তবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুরই কিছু না কিছু অবদান আছে একে পরিপূর্ণ এই চেহারার গঠনে, সেজন্য কিছু সম্পর্ক যে নেই, তা আমি বলছি না। হয়তো আকাশে উড়ে যাবার আগে সমতল রানওয়েতে মাটি আঁকড়ে, গাড়ির মতো গতি সৃষ্টি করার মতো জমিতে গতি বাড়িয়ে জমি ছেড়ে আকাশের ওই হাজার হাজার ফিট ওপরে ওড়া এরোপ্লেনটার মতো। সম্পর্ক আছে- সম্পর্ক ছাড়ার জন্য।
প্রথম থেকেই বলছি, আজকাল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যন্ত্রমানব/মানবীর সম্পর্কে নানারকম সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে। তার মধ্যে থেকে দেখছি যন্ত্রমানবের চেয়ে যন্ত্রমানবীর সম্পর্কে প্রচারটাই বেশি। চিন দেশের শিল্পনৈপুণ্য এবং বিজ্ঞানে এগিয়ে যাবার নানা রকম বিজ্ঞপ্তি। হাঁটাচলা, ওঠাবসা, কথা বলা বা আদেশ মানা সবই ঘটে সেই রোবট, যন্ত্র মানবীর সঙ্গে। আগে ভাবতাম মিথ্যে প্রচার। গপ্পোকে স্বপ্নের মোড়কে মুড়িয়ে বাস্তবে চেহারা দেবার এক ফিল্মি কৌশল। উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে নিজেদের দেশের রাজনৈতিক আদর্শের স্বপ্নময় মায়াবী মোহের টোপ ফেলা। ‘ওরা কী তাড়াতাড়ি কতো এগিয়ে গেছে!’ ওদের আদর্শই উন্নতির আদর্শ! ইত্যাদি ইত্যাদি কূটনৈতিক প্রচার সর্বস্ব রাজনীতি। কিন্তু বাস্তবে মানুষ সুখে আছে কি না, তা আমি সশরীরে ওদের বিভিন্ন দেশে গিয়ে দেখে এসেছি, বুঝেছি আর্ট এবং সায়েন্সের প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত মানুষকে পাশ কাটিয়ে যেমন অর্থনীতি বা কমার্সের রমরমা দুনিয়া। প্রতিটি মানুষই এই দৌড়ে প্রথম হবার জন্য নিজের মনুষ্যত্ব ছেড়ে এক একটা যন্ত্রমানবের দঙ্গল। ঠিক যেন পোলট্রির মুরগির মতো। ওরা খায় এক। দেখতে এক। সবারই লাল ঝুঁটি আর সাদা পালক। সব্বাই সুখে থাকার কপি পেস্ট করা অবস্থায়। রামের নাড়ি টিপে শ্যামের রোগ ও ধরা পড়ছে/পড়বে, এখানে আবেগের প্রশ্ন নেই। থাকলে সবারই এক আবেগ, একই গভীরতা, একই ওজনের। সেটা ভালো কী মন্দ জানি না, তবে এটুকু জানি, ওখানে আজ এযাবৎকালের মধ্যে তফাত নেই! সামগ্রিকভাবে সবাই একই রকম আছে।
নমঃ চাং লিং-এর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অনেক দিনের। ভদ্রলোক জাতে চিনে হলেও থাকেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। প্রথমে আলাপ হয় চিঠির মাধ্যমে, তবে গভীরতাটা বাড়ে আমি যখন শেষবার দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্দ্রজাল দেখাতে যাই তখন থেকে। অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর হল কট্টর ব্যবসায়ী। আবেগের বালাই মাত্র নেই। গভীরভাবে জাপান বিদ্বেষী। ওঁর মতে জাপানের সবকিছু খারাপ। আমি জাপানকে অ্যাত্তো ভালোবাসি দেখে উনি তো বলেই ফেলেছিলেন, আমার নাকি সব কিছু ভালো, কিন্তু ওই জাপানের প্রতি ভালোবাসাটাই একমাত্র খারাপ জিনিস। নইলে, আমি অন্য ভারতীয়দের মতো খুব ভালো খদ্দের!
খদ্দের?!! খুব চমকে উঠেছিলাম ওঁর মুখে ওই ‘খদ্দের’ বিশেষণটা শুনে। পরে আরও মেলামেশার পর বুঝি– উনি পৃথিবীর সবাইকে ওই খদ্দেরের মাপকাঠিতে মাপেন। শাঁসালো, ভালো, সরল খদ্দের আর তার বিপরীতে হল ‘জাপানি খদ্দের’। জঘন্য!! বাজারে আসবার আগে নতুন কোনও কিছুর খবর পেলে উনি আমাকে খবর দিয়ে জানান এবং তার সঙ্গে গুণাবলি, কত দাম, ক’দিনের গ্যারান্টি ইত্যাদি। ১০ বছর হল ওঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব। মাঝখানে একটা বিরাট অপারেশন হয় ‘হার্ট অপারেশন’। উনি যে অসুস্থ তা প্রথমে বুঝিনি। অপারেশনের পর ফিরে তাঁকে আরও তরতাজা দেখি, আরও চটপটে…। তবে জাপানিদের প্রতি ঘেন্নাটার কোনও রদবদল নেই। আগেও যেমন, এখনও তেমন।
দু’মাস আগে একদিন ওঁর কাছে ভিডিও কল পাই, দেখে তো ওঁকে আমি চিনতেই পারছিলাম না। ওঁর বয়স বরাবরই কত তা বুঝতে পারা যেত না। যেন একটা বয়সে স্থির হয়ে আটকে আছে, আর সেটা ৩০–ও হতে পারে আবার ৪০–৪৫-ও হতে পারে। শুনেছিলাম ওনাকে ফেস লিফট অপারেশন মানে মুখের চামড়া অপারেশন করে কোঁচকানো থেকে টানটানে পরিবর্তন করা। ফলে ওঁর বয়সটা যৌবনকে ধরে রাখতে পারে। দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হয়। তবে এই সাম্প্রতিককালে যেমন তরুণ তরুণ চেহারাটা উনি ফেস লিফট করে বানিয়েছেন- সেটা তাঁর মতো একজন অভিজ্ঞ লোকের একদম মানায়নি। পুরো ব্যক্তিত্বটাই পালটে গেছে। অন্য বন্ধুদের কাছে সেই বিবরণ শুনে বুঝে ছিলাম এই অদ্ভুত সত্যটা। এমনিতে চিনেদের নাক চ্যাপ্টা আর চোখ ছোট ছোট হয়। উনি অপারেশন করিয়ে সে দুঃখ কাটাবার চেষ্টা করেছেন। নাকটাকে একটা খাড়া আর চোখ দুটোকে আরও বড় করে খুলে যেন শিশু জগন্নাথ হয়ে গেছে। আমার তাতে অসুবিধা কিছু নেই… এবং প্রশ্নও তুলিনি। আর সেজন্য ও এই চেহারাটাই যেন তাঁর আসল চেহারা তেমনটাই যেন আমার মনে হয়। আমি শুধু বলেছি, ‘তুমি নিশ্চয়ই খুব লাভজনক ব্যবসা করছো… সেজন্য তোমাকে খুব আনন্দিত এবং তরতাজা মনে হচ্ছে।’
কথাগুলো শুনে সাধারণত একটা মানুষের যেমন সলজ্জ অভিব্যক্তি করা উচিত- তা কিন্তু হল না। বরঞ্চ এমন হাবভাব করতে শুরু করলেন যে উনি যে ‘হ্যান্ডসাম’ সেটা ওঁর জন্মগতভাবে পাওয়া। ব্যাপারটা শুধু আমার চোখে যে লেগেছে, তা নয়। আমার স্ত্রী জয়শ্রীরও চোখে পড়েছে। ও আড়ালে আমায় বলেছে, ‘অসহ্য! এই চিনেম্যানগুলো সব নির্লজ্জ! ওদের ধারণা ওঁরা হচ্ছে ঈশ্বরের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি! ন্যাকা!’
এবার চাং লিং কোয়া যে নতুন জিনিসটা আমাকে দেখাতে এসেছিল সেটা হল মেয়ে রোবট সঙ্গিনীর ক্যাটালগ। সাধারণত ক্যাটালগ বলতে যে রঙিন ছবি বই বলে আমরা যা ভেবে থাকি তা নয়, একেবারে দুটো স্ট্যান্ডফ্যান আর একটা টেবিল ফ্যান একসঙ্গে চালাতেই একের পর এক সুন্দরী মহিলা ত্রিমাত্রিক প্রোজেকশন মানে থ্রি ডি প্রোজেকশনে নানা রকম মহিলাকে চলতে, ফিরতে, হাসতে, নাচ দেখাতে শুরু করে দেয়। ছোট্ট পুতুলের সাইজের সেই প্রোজেকশন! আমি অবাক হয়ে দেখছি বলে ও বলল –‘এরা তো ক্যাটালগের ছবি। আমি তোমাকে রোবট মেয়ের একদম তোমার মনপসন্দ হাইটের এবং পোশাকে একদম হোম ডেলিভারি করিয়ে দিতে পারি। তোমাকে সস্তায় দেব, একদম জলের দরে। কারণ তাতে আমাদের প্রোডাক্টের মার্কেটিং-এ মানে বিজ্ঞাপনে সুবিধে হবে। তোমার কাছে এই প্রস্তাব নিয়ে আমি এবার এসেছি।’
আমি তো ‘থ’! বললাম– ‘ওই প্রমাণ সাইজের মেয়ে রোবো নিয়ে আমি কী করব? ওসব আমার দরকার নেই।’
ও বেশ অবাক হবার ভান করল। কিন্তু জমল না। মনে হল ব্যবসায়ী এক্সপ্রেশন! নকল অবাক।
বলল, ‘তোমার দলে তো ডজন দুয়েক সুন্দরী সহকারিণী আছেন তাঁরা আবার সংসারে ফিরে যান সময়ে সময়ে, তোমাকে আবার নতুন করে সহকারিণী শিল্পীকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হয়। এতে তোমাকে বহু ঝক্কি বইতে হয়। তবু যদি রোবট সুন্দরী দিয়ে ওদের কাজটা সারতে পারো তাহলে তো তুমি অনেক স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে। কোনও পাসপোর্ট, ভিসার দরকার নেই। অসুখবিসুখ-কোয়ারান্টিন-ইনজেকশনের ব্যাপার নেই। শুধু বাক্স থেকে খোলো আর তারপর স্টেজে নামিয়ে দাও। হোটেল, টিকিট, খাওয়া, থাকা, অসুখবিসুখ- কোনও কিছুর ঝক্কি নেই।’
আমার শুনতে মজা লাগছিল। বেশ মজা করে বলল তো এই ব্যবসায়ী চিনেম্যানটা। জনে জনে আর শেখাতে হবে না। একজনকে বেশ ভালো করে ধীরেসুস্থে শিখিয়ে তারপর শিক্ষাটা কপি পেস্ট করে দু’ডজন মেয়েকে শেখালেই চলবে। জামাকাপড়, পোশাক-আশাক সব এক সাইজের। চমৎকার! একেকজনকে শাসন করলে সবাই শিখবে একইসঙ্গে। চিনে সৈনিকদের কুচকাওয়াজ দেখেননি! সব একসঙ্গে- এটা ওই রোবটেরই ব্যাপার! চিন্তার সঙ্গে চিন্তা জুড়তে জুড়তে আরও নতুন চিন্তা এসে যায়। রোবটের যমজ রোবট হয়তো একই সঙ্গে কুচকাওয়াজ করতে পারলে একই ভুল যদি একজন করে, তাহলে একই ভুল সব রোবট করবে। যুক্তিতে তো তাই বলে। সুতরাং ওদের সৈনিকদের একখানাকে পাকড়াও করতে পারলে – তাকে ভুল শিখিয়ে অন্য রোবটদেরও শায়েস্তা করতে পারা উচিত। সামগ্রিক বা সমতালে।
কথাগুলো যখন আমি জয়শ্রীকে বললাম, তখনও আমায় এমন একটা দিক নিয়ে ওয়াকিবহাল করল যে আমি সেটা খেয়ালই করিনি। ও আমাদের দলে যন্ত্রমানবী সাপ্লাই করতে এত ব্যস্ত কেন? পুরুষ সহকারী কথা তো একবারও মুখে উচ্চারণ করেননি। তাঁরাও তো মহিলা সহকারীদের চেয়েও বেশি কাজে জড়িত আছেন!! কথাটা ও শুনতেই কেমন যেন অদ্ভুতভাবে পটপরিবর্তন হতে শুরু করল। সদা হাস্যময় চাং লিং কোয়া হঠাৎ খেপে উঠলেন এবং আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা শুরু করলেন যা আমি এই রোজনামচায় লিখতেও দ্বিধাবোধ করছি। এমনভাবে হঠাৎ পটপরিবর্তন যে হয় বা হতে পারে তা আমার কল্পনার দিগন্তেও আনতে পারছি না। ও কেমন যেন হঠাৎ টানটান হয়ে সোজা হয়ে গেল এবং ও মুখ না নেড়েই যেন ছোট্ট একটা স্পিকারের মধ্যে দিয়ে কাউ কাউ করে বেশ রাগের সঙ্গে বলতে শুরু করল। ও বলল – ‘দ্যাখো প্রদীপ… আমি জানতাম এই মুহূর্তটা একদিন আসবেই আসবে। তুমি জেনে যাবে আমার রহস্য কিন্তু যাবার আগে আমি তোমার পরিচালনার মেন সুইচটা অফ করে দেব। সবাইকে ফাঁস করে দেব… হেঃ…জাদুকর প্রদীপচন্দ্র সরকার ওরফে যে আমার মতো তুমিও একটা রোবট…”
বলেই ও আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আমার বাঁ কানের পেছনে খুব জোরে আঙুল দিয়ে চিপতে লাগল। মুখে বলল ‘আজ থেকে এখন থেকে আমি হব পিসি সরকার জুনিয়ার এবং তুমি হবে তোমার আসল যে জিনিস- তাই! তুমি একটা কেমিক্যাল রোবট। যন্ত্রপাতি মেকানিক্যাল মার্ভেল, তা তো আছেই তুমি আমার মতো এক সুপার চিপের দৌলতে পরিচালিত রোবট। আমি তোমাকে নিশ্চিহ্ন করব… আর সেজন্যই আমার সৃষ্টি।’
হঠাৎ আক্রমণে আমি হকচকিয়ে গেছিলাম। দেওয়ালে মাথা ঠুকে যায়। চাং লিং-এর এই চেহারা আমি ভাবতেও পারিনি। মাথায় দেওয়াল ঠুকে রক্ত বের হচ্ছে। কী করি, কী করি! হঠাৎ আমার ইচ্ছে জাগল ওর মতো আমিও ওঁর কানের তলাটা চিপে ধরি।
ব্যাস তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই। যখন আমার জ্ঞান ফিরল তখন দেখি ডাক্তারে ডাক্তারে ছয়লাপ। আমি অপারেশনের টেবিলে। আমার ক্ষতবিক্ষত শরীরটা ওনারা জোড়া লাগিয়েছেন। তিন সপ্তাহ ইতিমধ্যে কেটে গেছে আমার অজান্তেই। আমি চোখ খুলতেই ডাক্তাররা বললেন- ‘অপারেশন সাকসেসফুল উনি বেঁচে উঠেছেন… কিন্তু ওই অন্য রোবট মানুষটা চুরমার হয়ে গেছে… ওটাকে কিছু করা যাবে না…’
আবার আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু একটা অদ্ভুত সংবাদ নিয়ে চাং লিং কোয়া ছিল নিজেও একটা রোবট। ওর ধারণা ছিল আমিও আর একটা রোবট। নইলে এত ম্যাজিক পারি কীভাবে… খুব ঘুম পাচ্ছে…।