আবেগের ফানুস নয়, বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই ‘চ্যাম্পিয়ন’ মোলিনা

আবেগের ফানুস নয়, বাস্তবের মাটিতে পা রেখেই ‘চ্যাম্পিয়ন’ মোলিনা

জীবনযাপন/LIFE STYLE
Spread the love


সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: টি-২০ বিশ্বকাপের জেতার পর রোহিত শর্মা। উইলম্বডন জয়ের পর নোভাক জকোভিচ। দুজনের মধ্যে মিল কোথায়? মনে পড়তে পারে, দুই চ্যাম্পিয়নই চেখে দেখেছিলেন রণাঙ্গনের মাটি। মোহনবাগানকে লিগ শিল্ড জেতানোর পর কি মোলিনাও সেটাই করবেন? না, শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়ন তকমা পাওয়ার জন্য নয়। আসলে গোটা মরশুম জুড়ে বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ সবুজ-মেরুন জনতাকে। স্বপ্নপূরণের পর সেটার আস্বাদ কি তিনি নেবেন না?

‘সত্য যে কঠিন/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/ সে কখনও করে না বঞ্চনা’। মোহনবাগানের স্প্যানিশ কোচ রবীন্দ্রনাথের ‘রূপনারায়ণের কূলে’ পড়েননি। পড়লে টের পেতেন, এ যেন তাঁরই ফুটবল দর্শন। না, ভুল বলা হল। এ যেন তাঁর জীবন দর্শন। ফুটবল মাঠের নব্বই মিনিটের সঙ্গে যে কতভাবে মিশে যায় জীবনের লড়াই। লক্ষ্য থেকে সরে আসা যাবে না, প্রতিপক্ষ প্রবল চাপ দিলেও কাঁধ নোয়ানো যাবে না। লড়াইয়ের বীজমন্ত্র জীবন। সেটাই ফুটবলকে করে তোলে ‘দ্য বিউটিফুল গেম’।

মোলিনা সেটাই বিশ্বাস করেন। তাঁর পরিকল্পনা, ম্যাচ চলাকালীন প্লেয়ার বদল কিংবা জয়ের পরও যেভাবে বাস্তবের মাটিতে পা রাখেন, তাতে একটা জিনিস অত্যন্ত স্পষ্ট। কঠিন থেকে কঠিন পথে পাড়ি দিয়েও পাখির চোখ থেকে সরে আসেন না তিনি। আর এটাও হয়তো ঠিক যে, এবারও বাড়তি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেন না। টানা দুবার খেতাব জয়েও কাজ শেষ হয়নি। গত বছর অল্পের জন্য ফসকেছে আইএসএল কাপ। সবুজ-মেরুন ভক্তদের সেই আফসোস সুদে-আসলে মিটিয়ে দিতে চান। এর আগেও যখন এটিকে-কে চ্যাম্পিয়ন করেছেন, তখনও এই একরোখা বিশ্বাসই ছিল তাঁর সাফল্যের মন্ত্র। 

আর ওই যে ‘বঞ্চনা’র কথা উঠল, তখন ফিরে দেখা যাক মরশুমের গোড়ার ইতিবৃত্তে। ডুরান্ডের ফাইনালে নর্থইস্টের কাছে হার। আইএসএলের প্রথম তিন ম্যাচে মাত্র ৪ পয়েন্ট। ৭ গোল হজম করতে হয়েছিল সেই সময়ে। হার-জিতের কুহকী পথ পেরিয়ে কোন জাদুমন্ত্রে বদলে দিলেন আইএসএলের পাশা? উত্তর এক নয়, একাধিক। তিন ডিফেন্সের ফর্মুলা থেকে নিঃশব্দে সরে এলেন। ভরসা রাখলেন দুই বিদেশি সেন্টার ব্যাকে। এবারের আইএসএলের আবিষ্কার, মোহনবাগানের নতুন তারকা দীপেন্দুর ভূমিকা সামান্য অদল-বদল করে আরও স্বাধীনতা দিলেন। নবজন্ম ঘটল অধিনায়ক শুভাশিসের। ভক্তদের ‘আদরের’ দিমিকে বসিয়ে দিতেও পিছপা হননি। কখনও অভিষেক সূর্যবংশী, কখনও দীপক টাংরি, যে যখন নেমেছে, নিজেদের সেরাটা দিয়েছে। আবার কামিংসকে কখন যে ‘নম্বর ১০’ করে দিলেন, তা ধরা পড়ার আগেই কেল্লাফতে। আর অবশ্যই সম্মান করেছেন ভক্তদের আবেগকে।

অথচ, এই নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য দেখেছেন? কিংবা শুনতে পেয়েছেন কোনও তারকাকে বসিয়ে দেওয়ায় দলের মধ্যে অশান্তির খবর? না, কোথাও কিচ্ছু নেই। অনেকে বলতে পারেন মোলিনার সমস্ত সিদ্ধান্ত ‘ক্লিক’ করে গিয়েছে। সেটা নয়। টেকনিক্যাল বদল ঘটলেও, নিজের আদর্শ থেকে কখনও সরে আসেননি মোলিনা। আর সেটা হল টিম গেম। হার হোক বা জিত, প্রতিটা ম্যাচের পর একটা কথাই বলেছেন। সকলকে গোল করতে হবে, সকলকে ডিফেন্ড করতে হবে। এ মোলিনার নিজস্ব ‘টোটাল ফুটবল’। তাই মোহনবাগানের সর্বোচ্চ গোলদাতার নাম যদি ম্যাকলারেন হয়, তাহলে তারপরই নাম থাকবে শুভাশিস বোস ও আলবার্তো রদ্রিগেজের। প্রমাণ করে দিয়েছেন, ‘অ্যাটাক উইন ইউ গেমস, ডিফেন্স উইন ইউ টাইটেলস’। দিনের শেষে দলের জয়টা শেষ কথা। দিনের শেষে একসঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকাটাই স্বপ্নপূরণের চাবিকাঠি। ইস্টবেঙ্গল হোক বা মহামেডান, দুদফায় চারটি ডার্বি জিতেও নিজেকে ‘মহান’ করে তোলার বিন্দুমাত্র ছবি চোখে পড়ে না। 

ভাবতে অবাক লাগে, কেরালাকে ৩-০ গোলে উড়িয়েও মোলিনা বলেন, “এটাই সবচেয়ে কঠিন সময়। এই সময়েই আমাদের সবচেয়ে বেশি মনোনিবেশ করতে হবে।” লিগ শিল্ড জয় যে ততক্ষণে প্রায় নিশ্চিত। অথচ তারপরও খেতাব নিয়ে বাড়তি কোনও কথা নেই। শুধু জানান, আরও পরিশ্রম করতে হবে। এখানে নজর দেওয়া যাক ‘মনোনিবেশ’ শব্দটিতে। আজ শিল্ড জয়ের আনন্দে প্রবল উচ্ছ্বাস। কিন্তু মোলিনা জানেন, ফোকাস ধরে রাখা একটা ধারাবাহিক কাজ। কাপ আর ঠোঁটের মধ্যে দিয়ে ঝরে যেতে পারে অসংখ্য সম্ভাবনা। জীবন বড় ছলনাময়। কখন যে নদী বাঁক নিয়ে প্লাবনে দুকূল ভাসিয়ে দেবে, তার হিসেব কে রাখে! ফুটবলও তো তাই। কয়েক সেকেন্ডের কাউন্টার অ্যাটাক ম্যাচের রং বদলে দেয়। একটা ছোট্ট ভুল ‘বাটারফ্লাই এফেক্টে’ যাবতীয় পরিশ্রম পণ্ড করে দিতে পারে। মোলিনা সেটা ভালোমতোই জানেন। ফুটবলের সেই মায়াময় ফাঁদে পা দিতে চান না। তাই তিনি চ্যাম্পিয়ন, থুড়ি তাঁর দল চ্যাম্পিয়ন। টানা দুবার খেতাব জয়ে ভারতীয় ফুটবলে নতুন ইতিহাস লিখল মোহনবাগান। বহু চড়াই-উৎরাই পার করে অমলিন হয়ে থাকল মোলিনার নামও। তার জন্য যে আরেকবার উদ্ধৃত করা যায় রবি ঠাকুরের বাণী,
“অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।”



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *