যুদ্ধ বাধলে দেশের অধিকাংশ মানুষ এখন খুশি হবেন সন্দেহ নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত যাই হোক, দেশবাসী কার্যত যুদ্ধ মোডে। প্রায় সম্মিলিত ইচ্ছা এখন, পাকিস্তানকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক। বিরোধীরাও প্রত্যাঘাতে একমত। সেটা তাদের কৌশল হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ বাধলে বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষেই এখন দাঁড়াবে। পুলওয়ামা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভোটে ধাক্কা খাওয়ার ক্ষত এখনও শুকোয়নি। তাই বিরোধীরা এবার সরকারকে আগাম ফ্রি হ্যান্ড দিয়ে রেখেছে।
বরং যুদ্ধ না বাধলে, জঙ্গিদের প্রত্যাঘাত না করলে সরকারকে চেপে ধরবে বিরোধীরা। ইতিমধ্যে তার আভাস মিলছে। মোদির আদলে পোশাক পরা কবন্ধ একটি দেহ পোস্ট করে কেন্দ্রকে নিষ্কর্মা, অপদার্থ বলার আবহ তৈরি করেছে কংগ্রেস। দেশবাসীর প্রত্যাশার চাপ এমনই যে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে (যিনি খুব বেশি বিতর্কিত বা স্পর্শকাতর মন্তব্য সহসা করেন না) দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে হয়েছে, আপনারা যা চান, তাই হবে।
নয়াদিল্লির নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লকে তৎপরতার অভাব নেই। এবেলা-ওবেলা মিটিং হচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কখনও তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে মিটিং করছেন। কখনও সব বাহিনীর সঙ্গে আলাদা আলাদা কথা বলছেন। সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিবৃতি না দিলেও প্রচার করে দেওয়া হয়েছে, প্রত্যাঘাতে তিন বাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ বাধবে- এমন কোনও সংকেত এখনও নেই।
পাকিস্তান নিজে থেকে আক্রমণ করবে, এমন কোনও ইঙ্গিত নেই। তবে প্ররোচনা দিয়ে চলেছে নিত্যদিন। কখনও পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি, কখনও নৌবাহিনীর মহড়া, মিসাইলের পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণ এবং গত ১১ দিন ধরে নিয়ন্ত্রণরেখায় গোলাগুলি বর্ষণ করে চলেছে পাকিস্তান। ভারতের দিক থেকে জবাব দেওয়া হচ্ছে ঠিকই। তবে তা ওই পর্যন্তই। কেননা, যতই আস্ফালন চলুক, যুদ্ধ হিসেব কষে করতে হয়।
শুধু সামরিক অঙ্ক নয়, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ইত্যাদি নানা সমীকরণের সমাধান না করে আজকের দিনে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়া বোকামি। বিশ্ব ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী চলতি বছরে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি ৭ শতাংশ হতে পারে। যুদ্ধ বাধলে সেই হার ধরে রাখা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়বে আগামী বছরগুলিতে বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচনে। যুদ্ধে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হবে, তা জোগাতে গিয়ে হাঁড়ির হাল হতে পারে দেশের কোষাগারের।
দেশবাসীর সমর্থন তখন ক্ষোভের আগুনে পরিণত হতে সময় লাগবে না। সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দেওয়ার সুযোগ বিরোধীরা তখন ছাড়বে না। দ্বিতীয়ত, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এখন ভারতের পক্ষে অনুকূল নয়। চিরদিনের বিশ্বস্ত বাংলাদেশের সম্পর্ক িতক্ত। নেপালের সঙ্গে চিনের সখ্য ভারতের তুলনায় অনেক বেশি। শ্রীলঙ্কা, ভুটানের সঙ্গে আগের মতো সম্পর্ক নেই। এই অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিলে প্রতিবেশী কেউ পাশে দাঁড়াবে- এমন নিশ্চয়তা কম।
বরং নিজের স্বার্থে সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে চিন। তেমন পরিস্থিতি ডেকে আনা ভারতের পক্ষে সুখকর হবে না। তাছাড়া সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানের গভীরে ঢুকে যেতে হতে পারে। তখন তো আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সুবিধা থাকবে না যে, একবার মেরে ফেরত আসা যাবে। দীর্ঘস্থায়ী সেই যুদ্ধে অর্থনীতি, রাজনীতির পাশাপাশি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে চাপ বাড়বে। তৈরি হতে পারে নিঃসঙ্গতাও।
নরেন্দ্র মোদি-অমিত শা সেই বাস্তবতা ভালোই জানেন। পাকিস্তানি প্ররোচনার জবাবে গরম গরম মন্তব্যের পাশাপাশি সে কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিষয়টিকে কূটনৈতিক স্নায়ুযুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ইসলামাবাদ আগ বাড়িয়ে কিছু না করে বসলে সীমান্তে কামানের গোলায় ভারত যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দেবে বলে মনে হচ্ছে না। ভারতের মতো পরিস্থিতি পাকিস্তানেরও। যুক্তিগুলি একই। ফলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন বা ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের পুনরাবৃত্তি ঘটা কঠিন।