ক্রমশ ফ্যাকাসে হতে থাকা লালের জমানায় হাল ছাড়েননি আজিজুল হক। মাঝে মাঝে খালি স্বগতোক্তি করতেন, বয়সটা যদি কুড়ি বছর কম থাকত! তিনি স্বপ্ন দেখতেন ক্রমশ ফ্যাকাসে হতে থাকা আবছা বুদ্বুদের মধ্যে লাল টুকটুকে দিনের–রক্তিম বিস্ফোরণের। লিখছেন কিন্নর রায়।
বাংলা কবিতা ও গদ্যর কোনও এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ‘মুখুজ্জে’ তাঁর সঙ্গে আলাপ জমে জমাট হওয়া অনেক, অনেক বছর আগে ‘লাল টুকটুকে দিনের স্বপ্ন’ দেখিয়েছিলেন আমাদের অনেককে। তত দিনে ‘পদাতিক’, ‘অগ্নিকোণ’ আর ‘জাপ-পুষ্পকে জ্বলে ক্যান্টন, জ্বলে হ্যাঙচাও’, সেই সঙ্গে ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’-র বার্তা বাংলা ভাষার আকাশে উড়ছে ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি হয়ে। সেই সময়টা খুব যে ভাল সময়, এমন তো নয়, তবু তো স্বপ্নের দিন, লাল স্বপ্ন। আটের দশকে সেসব টুকটুকে লাল খোয়াবেরা ধীরে ধীরে কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। আর আটের দশকে আজিজুল হক যখন জেলে, তখন এই রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার। আজিজুল হক– কমিউনিস্ট বিপ্লবী
আজিজুল হক। নকশালবাড়ির ধারায় সশস্ত্র আন্দোলন করতে চাওয়া ‘দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি’– সিপিআই(এমএল) সেকেন্ড সিসি-র একটা অংশ– তারই নেতৃত্বে আজিজুল হক এবং নিশীথ ভট্টাচার্য। আর যে স্বাধীন সরকার তৈরি হয় নদিয়ার গ্রামাঞ্চলে, মুক্তাঞ্চলের অখণ্ড খোয়াব, সেখানে সেই সরকারের সমরমন্ত্রী আজিজুল হক। সাপ্তাহিক ‘পরিবর্তন’ পত্রিকায় এই বিষয়টি নিয়ে এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, ছবি-সহ। তখনও রমেন সাহা-র রেনিগেডত্ব, ফলাফলে রমেন সাহা খুন হয়ে যাওয়া, সেই ঘটনার কেউ আমাদের সামনে নেই।
১৯৮২-তে গ্রেপ্তার হলেন আজিজুল হক। এই ধরা পড়া, মুক্তি– সবই তো চিহ্নিত হয়ে আছে তঁার ‘কারাগারে ১৮ বছর’-এ। সেকেন্ড সিসি– সিপিআই(এমএল)-এর দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটিতে একজন চাকরি ছেড়ে দেওয়া, প্রাক্তন বিডিও অনিলবরণ রায়, আসেন সিওসি ঘুরে। সঙ্গে সুবীর তালুকদার, যঁাদের নামও খবরের কাগজে অল্পবিস্তর ছাপা হয় ছোট খবরের সঙ্গে। শান্তি পাল ছিলেন সিওসি-তে। তুলনায় প্রায় পাবলিসিটি-প্রচারহীন অবস্থায় থাকেন আরএসপি (এমএল)-এর সশস্ত্র যোদ্ধারা, যঁাদের কাজ মূলত দিনাজপুরের গ্রামে কৃষকদের, ভূমিহীন কৃষকদের মধে্য স-রাইফেল, স-বন্দুক। সে সব কথা এখন নয় থাক।
আজিজুল হকের কারামুক্তির দাবিতে ‘আজকাল’ পত্রিকা ও তার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত খুব বড় ভূমিকা নেন, সেই সঙ্গে কথাকার আজিজুল হক, যঁাকে সবসময়, ‘আমার শৈবালদা, অামার নেতা’ বলতেন, সেই শৈবালদা– কথাকার শৈবাল মিত্র প্রচুর লেখালিখি করেন– বিষয়টি নিয়ে সভা হয়।
‘প্রতিক্ষণ’, ‘পাক্ষিক প্রতিক্ষণ’-এ আজিজুল হকের মুক্তির দাবিতে লেখালিখি-প্রতিবেদন নির্মাণ শুরু হয়। কারাপ্রাচীর টপকে উড়ে আসে আজিজুল হকের চিঠি, তা ছাপাও হয়। আমি তখন ‘পাক্ষিক প্রতিক্ষণ’-এ সাব-এডিটরগিরি করি, মাসমাইনে ৬০০। ১৯৮৯ সালে প্রবল আন্দোলন, লেখালিখির ধারাবাহিক চাপে, সেই সঙ্গে বন্দি-মুক্তির দাবিতে সভা-সমিতির গুঞ্জন, কলরোল এবং নির্ঘোষে মুক্তি পেলেন আজিজুল হক। ১৯৮৭-’৮৮ সালে আজিজুল হকের সহ-জীবনজন মণিদীপা বক্সি (মণিদীপা হক), যিনি আজিজুলদার বিষয়ে বাইরে বলতে গেলে ‘হকসাহেব’ বলে উল্লেখ করতেন, তিনি তঁার পুত্র ও কন্যাদের নিয়ে প্রায়ই ‘প্রতিক্ষণ’ অফিসে, ৭ নম্বর জওহরলাল নেহরু রোডে, আমেরিকান লাইব্রেরি, ইউএসআইএসও কটেজ ইন্ডাস্ট্রির উপরের তলায় চলে আসতেন ইতিহাসের নানা কোণ স্পর্শ করা সিঁড়ি বেয়ে। সেই বাড়িই হোয়াইট লেডল ওরফে ‘হোয়াইটওয়েজ অ্যান্ড লেডল’ বিল্ডিং (বর্তমানে মেট্রোপলিটন বিল্ডিং), সেখানেই জীবনবিমার অতি প্রাচীন অফিস ও ক্যান্টিন।
মণিদীপা হক খুব সহজেই ‘মণিদীপাদি’ হয়ে গিয়েছিলেন। আর জেল থেকে বেরনোর পর আজিজুল হক– আজিজুলদা। ‘আজকাল’-এর চারের পাতায় নিয়মিত উত্তর সম্পাদকীয় লিখতেন আজিজুলদা। সাংবাদিকতা ছিল তঁার অন্যতম আবেগের জায়গা। ‘আজকাল’ তঁার রাজনৈতিক অবস্থান, মত ও পথ। এ রাজে্য ২০১১-র ক্ষমতা বদলের পর বদলে গেল ‘আজকাল’-এর আপাদমস্তক। সে-কথাও নয় থাক। ‘আজকাল’ শারদসংখ্যাতেও নিয়মিত লেখক ছিলেন তিনি।
আমার সঙ্গে তঁার ব্যক্তিগত যোগাযোগ, সখ্য ছিল যথেষ্ট। বহু প্রতিবাদসভায় আমরা গিয়েছি একসঙ্গে, বক্তা হিসাবে। আবার মার খাওয়া মানুষের পাশে দঁাড়ানোর জন্য আমাদের যাত্রা ছিল ধারাবাহিক। বহু সময়ই এই যাত্রার আহ্বায়ক ছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী ভারতী মুৎসুদ্দি।
আজিজুলদা ২০০৯-’১০ এই সময়টা ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’-তে প্রায় দিনই বসতেন। সঙ্গে থাকতেন বাসু আচার্য। বাসু রাজনৈতিক কর্মী ও ভাবুক। জীবনের নানা বিষয়ে তঁার আগ্রহ। মন্দির স্থাপত্য থেকে মূর্তির বিষয়, বিপুল মেধাযুক্ত পড়াশোনা ও পরিশ্রম। সেই সঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও নকশালবাড়ির ধারার আন্দোলনের ইতিহাস।
বাসু তখন আজিজুলদার ছায়াসঙ্গী। আজিজুলদা আমাকে ‘মোঁসিয়ে কিন্নর’ বলে সম্বোধন করতেন, দেখা হলেই। এর পিছনেও টুকরো দু’টি ইতিহাস আছে। সেই প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না।
আমার ‘প্রকৃতিপাঠ’-এর একটা সমালোচনা লিখেছিলেন আজিজুলদা ‘পরিচয়’ পত্রিকায়। কবি ও গদ্যকার অমিতাভ দাশগুপ্ত তখন ‘পরিচয়’-এর সম্পাদক। ‘আজকাল’-এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও মানসিক দূরত্ব তৈরি হওয়ার পর ‘সময়ের ঘড়ি’ আর ‘হক-কথা’ এই নামে দু’টি ট্যাবলয়েড প্রকাশিত হয় আজিজুল হকের সম্পাদনায়। মনে আছে, তঁার পুত্র মোটরবাইক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর পেয়ে দেখা করতে গিয়েছি আজিজুলদার আনোয়ার শাহ রোডের বাড়িতে। লাল গ্রিলের বাইরের গেটে কাস্তে-হাতুড়ি। ভিতরে অটুট নীরবতা। মণিদীপাদি দু’-একটা কথা বলার পর ভাঙলেন, কান্নায়।
আজিজুলদা চুপ, স্থির। আনোয়ার শাহ থেকে সল্টলেক চলে গেলেন আজিজুলদা। আস্তানা বদল হল। চমৎকার বাজার করতে পারতেন। সেই সঙ্গে উপাদেয় রন্ধনশৈলী। রান্নায় মশলার ব্যবহার, তাতেও তঁার অদ্ভুত কুশলতা। আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘শাক খাস?’ আমি বললাম, ‘হঁ্যা।’ বললেন, ‘খাবি, খাবি, রোজ খাবি। টাটকা শাক।’ নিজেও খুব পছন্দ করতেন শাক।
নানা জটিলতায় তঁার সম্পাদনার একটি ট্যাবলয়েড বন্ধ হয়ে গিয়ে, তখন নতুন ট্যাবলয়েডে হাত দিয়েছেন। হাত কঁাপত দীর্ঘ দিন– কারণ পারকিনসন্স। খইনি আর চা-নির্ভর মানুষটি বেশি চিনি দিয়ে চা খেতেন। রক্তে চিনির সমস্যা ছিল না। কলকাতার অতি প্রখ্যাত সার্জন ডা. সমরেশ বন্দে্যাপাধ্যায় ছিলেন আজিজুলদার অত্যন্ত কল্যাণকামী। মাঝে মাঝেই নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে রক্ত নিতে হত তঁাকে। তরতর করে নেমে যেত হিমোগ্লোবিন। রক্ত বেরিয়ে আসত শরীর থেকে। ডা. সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় তঁার নিজস্ব উদে্যাগে আজিজুল হককে ভর্তি করে দিতেন নার্সিংহোমে। চারদিন, পঁাচদিন, সাতদিন চিকিৎসা পর্ব।
রক্ত দেওয়া।
জীবনের প্রায় শেষবেলায় পৌঁছে চারু মজুমদার, মাও-ৎসে-তুং-এর সঙ্গে কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিজের লেখালিখি, বোধ-বিশ্বাস, কথাফেরতা ও জীবন ঘষার মধে্য। রবীন্দ্রনাথে বারে বারে ঘুরে ঘুরে আসতেন। সেই সঙ্গে রমা রলঁ্যা, কার্ল মার্কস। ইদানীং কয়েক বছর রবীন্দ্রনাথকে যেন অনেক অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন লেখায়-বলায়।
ক্রমশ ফ্যাকাসে হতে থাকা লালের জমানায় হাল ছাড়েননি আজিজুল। মাঝে মাঝে খালি স্বগতোক্তি করতেন, বয়সটা যদি কুড়ি বছর কম থাকত! তিনি স্বপ্ন দেখতেন ক্রমশ ফ্যাকাসে হতে থাকা লালের অাবছা বুদ্বুদের মধে্য লাল টুকটুকে দিনের– যা এক ‘মুখুজ্জে’ দেখেছিলেন অনেক অনেক দিন আগে।
কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেস সরকার ও জনতা পার্টির সরকারের মন্ত্রী ছিলেন ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এই মানুষটি মণিদীপা বক্সির অতি নিকটাত্মীয়। দাদা ইন্দ্র বক্সি ছিলেন আজিজুল হকের সহযোদ্ধা– পার্টি কমরেড।
নিজের আয়ুষ্কালেই সত্তর বছরের সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেখেছেন অাজিজুল। দেখেছেন চেয়ারম্যানের চিনের সমাজতন্ত্র থেকে পুঁজিতন্ত্র-পার্টিতন্ত্র-ব্যবসাতন্ত্রে বৃহৎ– ‘অতি বৃহৎ উল্লম্ফন’। মাও থেকে দেং জিয়াও পিং। তারপর ড্রোন ও বিমানব্যবসায় শি জিনপিংকে। দেশ ও বিশ্বজুড়ে অনেক লাল পতাকাই ফ্যাকাসে হতে থাকে, এর মধে্যই বসন্তের বজ্রনির্ঘোষী স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লেন সর্বদা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে চাওয়া অাজিজুল হক। যেমন, ‘বিপজ্জনক শিশু’ ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন।
কানোরিয়া-সহ সমসাময়িক নানা আন্দোলনে ঝঁাপিয়ে পড়লেও ভাঙরের পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে আমরা, সেই সঙ্গে ভাঙরবাসী, কখনও পায়নি তঁাকে, যত দূর জানি অলীক চক্রবর্তী-শর্মিষ্ঠাদের বাদ অন্য কোনও কোনও পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের একাংশের বিষয়ে নানা সংশয় ছিল তঁার। বলেওছেন সেই কথা একাধিকবার নানা সময়।
ঘুমিয়েই পড়লেন আজিজুল, সূর্য-চঁাদ-নক্ষত্র গিলে খাওয়া গভীর অন্ধকারের মধে্যই লাল-লাল টুকুটুকে দিন আর রক্তিম বিস্ফোরণের খোয়াব নিয়ে। যদিও তঁার চারপাশেই এখন প্রায় স্থির, অবনত ফ্যাকাসে হয়ে ওঠা লাল পতাকারা।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক কথাসাহিত্যিক