অসীমের ডাক শুনি ‘কল্লোল’ মর্মরে, উৎপল দত্তের মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা

অসীমের ডাক শুনি ‘কল্লোল’ মর্মরে, উৎপল দত্তের মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা

সিনেমা/বিনোদন/থিয়েটার
Spread the love


১৯৬৫ সালের ২৮ মার্চ মিনার্ভায় প্রথম মঞ্চস্থ হয় উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’। যার কেন্দ্রীয় বিষয়– ১৯৪৬ সালের ‘নৌবিদ্রোহ’। তৎকালীন রাজ্য সরকার ‘কল্লোল’-সৃষ্ট অভূতপূর্ব আলোড়নকে ভাল চোখে দেখেনি। চোরাগোপ্তা হামলা, একাধিক বৃহৎ সংবাদপত্রগোষ্ঠীর ঔদাসীন্য তো ছিলই– এমনকী, গ্রেপ্তার করা হয়েছিল নাট্যকারকেও। ১৯ আগস্ট, উৎপল দত্ত-র মৃত্যুদিনে ফিরে দেখা ইতিহাস। লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়

‘নৌবিদ্রোহ’-র পটভূমিকায় উৎপল দত্তের ‘কল্লোল’ নাটকটি ভারতের থিয়েটারের ইতিহাসের একটি মাইলফলক। ১৯৬৫ সালের ২৮ মার্চ মিনার্ভায় প্রথম মঞ্চস্থ হয় ‘কল্লোল’। এই নাটককে কেন্দ্র করে ছয়ের দশকের মধ্যভাগে দেখা গিয়েছিল অভূতপূর্ব গণ-আন্দোলনের জোয়ার, যা তখনকার রাজ্য রাজনীতিতে নজিরবিহীনভাবে উত্তাল আলোড়ন ঘটিয়েছিল।
‘কল্লোল’ লেখার প্রেরণা ছিল ব্রিটিশ সরকারের ‘নিষিদ্ধ’ পুস্তিকা– ১৯৪৬ সালের ‘নৌবিদ্রোহ’। যা শাহদাৎ আলি রচিত। লালবাজারের পুলিশের কেন্দ্রীয় সংগ্রহশালা থেকে গোপনে একজন পুলিশ অফিসার এই বইটি উৎপলকে এনে দিয়েছিলেন। উৎপল এই নাটকে নৌবিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং কংগ্রেস নেতৃত্বের নেতিবাচক ভূমিকা তুলে ধরেন।

‘কল্লোল’ নাটকে ‘শার্দুল সিং’-এর ভূমিকায় শেখর চট্টোপাধ্যায়, ‘ইয়াকুব’ চরিত্রে নির্মল ঘোষ, ‘কৃষ্ণাবাঈ’ ও ‘লক্ষ্মীবাঈ’-র ভূমিকায় যথাক্রমে শোভা সেন ও গীতা সেন, আর ‘র‍্যাটট্রে’ চরিত্রে স্বয়ং নাট্যকার ও পরিচালক উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন। সংগীত পরিচালক ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। মঞ্চের উপর জাহাজ দেখানো দর্শকদের কাছে আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। যেজন্য ‘কল্লোল’ মঞ্চস্থ হওয়ার পর কোনও-কোনও মহল থেকে অভিযোগ উঠেছিল যে, আঙ্গিকের ভেলকি ও চমক দিয়ে অভিনব পদ্ধতিতে খাইবার জাহাজ দেখিয়ে উৎপল বাজিমাত করেছেন!

কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য করেছিলেন– “ভারতীয় নৌবিদ্রোহের পটভূমিকায় ‘কল্লোল’ নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করে উৎপল দত্ত আশ্চর্য সাহস ও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। টেকনিকের চমকপ্রদ ব্যবহার এতে অনেক আছে কিন্তু টেকনিক সর্বস্বতার অপবাদ দেওয়া চলে না, কারণ টেকনিক বিষয়বস্তুকে ছাপিয়ে কখনো উগ্র প্রাধান্য লাভ করেনি।’ অস্বীকার করার উপায় নেই– মঞ্চে যতই চমক থাকুক না কেন– ইতিহাসের পাতা থেকে নৌবিদ্রোহের বির্তকিত দিকটি তুলে এনে শাসকের বিরুদ্ধে জনগণকে প্রতিবাদমনস্ক করে তুলেছিল এই নাটক। ‘কল্লোল’ সেজন্য বিদ্রোহী নৌযোদ্ধাদের বীরগাথার মৃত্যুঞ্জয়ী উপাখ্যান
হয়ে ওঠে।

শুরু থেকেই ‘কল্লোল’ দেখতে বিডন স্ট্রিটে উপচে পড়ে ভিড়। মিনার্ভার প্রতিটি শো তখন ছিল ‘হাউসফুল’। ‘কল্লোল’ শহরের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল। যা দেখে তৎকালীন রাইটার্স বিল্ডিং বিপদ ঘণ্টা শুনতে পায়। এই নাটকের বিষয়বস্তু সমসাময়িক শাসককে
স্পষ্টতই অস্বস্তিতে ফেলেছিল। কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাটকের শো ভণ্ডুল করতে দুর্বৃত্তদের দিয়ে ঝামেলা করানো শুরু হয়। হট্টগোল সৃষ্টি করতে এলাকায় বোমাবাজিও চলে। জেসপ কারখানার শ্রমিক এবং বেশ কয়েকটি কলেজের বামভাবাপন্ন ছাত্ররা এগিয়ে আসেন– গুন্ডাদের মোকাবিলায় এবং নাটকের দর্শকদের নিরাপত্তা দিতে।
সেই সময় সার্বিকভাবে বৃহৎ সংবাদপত্ররা উৎপলের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল! ‘The Statesman’ কাগজ ব্যঙ্গ করে লিখেছিল– ‘The Mutiny of Beadon Avenue’। উৎপল অবশ্য পাল্টা লিখেছিলেন– ‘দ্য স্টেটসম্যান ভুল ইংরেজির হেডলাইন দিয়ে নৌবিদ্রোহ নয়, বিডন স্ট্রিটের বিদ্রোহকে উদ্‌ঘাটিত করতে চাইল।’

তখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ নয়, ফলে নাটকের প্রচারের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের গুরুত্ব ছিল অসীম। কিন্তু উৎপলের ‘কল্লোল’ রাজরোষে পড়েছে বুঝে সেই সময় এ রাজ্যের বড়-বড় সংবাদপত্রে ‘কল্লোল’-এর বিজ্ঞাপন ‘নিষিদ্ধ’ হল। একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক ঘোষণা করেছিল– ‘কমিউনিস্টদের বেলেল্লাপনার আখড়া মিনার্ভা থিয়েটার এবং তার নাটের গুরু উৎপল দত্তকে হেনস্থা করে স্তব্ধ করে দিতে হবে।’ কিন্তু জনস্রোতে উদ্বেলিত মিনার্ভায় ‘কল্লোল চলছে চলবে’-র মিছিলে ও পোস্টারে মহানগরীর এমন গণতন্ত্রবিরোধিতা সেদিন ধাক্কা খেয়েছিল। এবং বাংলা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাড়াই মানুষের মুখে-মুখে এই নাটকের নির্যাস ছড়িয়ে যায়।

সত্যজিৎ রায়ের নেতৃত্বে এবং তাপস সেনের পোস্টারের ভাষার জাদুতে ‘কল্লোল’-এর জয়যাত্রা আটকাতে ব্যর্থ হল উৎপল-বিরোধী শাসক। নাট্যকার মন্মথ রায় এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে লেখেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যকার উৎপলের ‘কল্লোল’ নাটকের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে ওই সংবাদপত্র ‘পরমতঅসহিষ্ণুতা’-র প্রকাশ করেছে, অন্যদিকে ‘জাতির মুখপত্রের দাবিদার’ যারা, তাদের এই আচরণে ‘ফ্যাসিবাদ’-এর প্রস্তুতিপর্বের আভাস মিলছে।

১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চলাকালীন শারদীয়া ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকায় উৎপল দত্ত লিখেছিলেন– ‘সংগ্রামের আরেকদিক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। অচিরেই প্রবন্ধটিকে ‘দেশবিরোধী এবং রাষ্ট্রবিরোধী’ তকমা দিয়ে পত্রিকার ওই সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করা হল। সে-বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে উৎপল দত্তকে গ্রেফতার করা হয়। তঁার ভাষায়, ‘যুদ্ধবিরতির (ভারত-পাক যুদ্ধ) দিনে আমাকে আমার বাড়িতে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং বিনা বিচারে প্রেসিডেন্সি জেলে আটক রাখা হয়েছিল…’। এদিকে, তখন বিশ্বজুড়ে ‘কল্লোল’ নাটকের সমর্থনে এবং উৎপল দত্তের মুক্তির দাবিতে সাংস্কৃতিক জগতে আওয়াজ ওঠে।

সোভিয়েত কবি দোলমাতোভস্কি, জার্মান নাট্যকার ফনকুবা ও পরিচালক হান্স পের্টেন, প্রাগে দুসান জবাভিতেল, লন্ডনে ওয়াল্টার নান, ‘দ্য অবজার্ভার’-‘দ্য টাইম্‌স’-‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকা, মার্কিন আন্ডারগ্রাউন্ড থিয়েটারের জোসেফ সেল্‌বি এবং ভারতে সত্যজিৎ রায়, মধু বসু ও মন্মথ রায়ের নেতৃত্বে অসংখ্য শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী এই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ তঁার মুক্তির দাবিতে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ বিশাল প্রতিবাদী মিছিলে সামিল হন– যাতে অংশ নেন সত্যজিৎ রায়ও। ঘরে-বাইরে চাপ বাড়ছে বুঝে কয়েক দিন বাদেই জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় উৎপলকে। নাটকের মানুষের এমন রাজনৈতিক মুক্তি দারুণভাবে উদ্‌যাপন করা হয়েছিল। ৭ মে ময়দানে এই কারামুক্তির স্মরণে বামপন্থীদের ততরফে বহু স্মৃতিবিজড়িত ‘কল্লোল বিজয় উৎসব’ আয়োজন করা হয়। সমাবেশে খাইবার জাহাজের ডেকের আদলে সাজানো মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন জ্যোতি বসু-সহ আরও অনেক নেতানেত্রী।

১৯৯৩ সালে ১৯ আগস্ট, উৎপল দত্তের মৃত্যুর পর, কেটে গিয়েছে তিন দশকের বেশি সময়। তবু গত শতকের ছয়ের দশকের ‘কল্লোল’ আর চারের দশকের হওয়া ‘নৌবিদ্রোহ’ এখনও ভারতে প্রাসঙ্গিক– বিশেষত, যখন দেখি সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং ভারতের সঙ্গে পড়শি দেশের বিদ্বেষ বাড়ছে। ‘নৌবিদ্রোহ’-র সময় কিন্তু বিদ্রোহী জাহাজগুলিতে তিনটি পতাকা একসঙ্গে বঁাধা হয়েছিল– কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই)। সেদিন সাম্প্রদায়িকতার বদলে বিদ্রোহী সাধারণ নাবিকেরা সামূহিক ঐক্যের বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার প্রাক্কালে এই ধরনের অস্থিরতায় লুকিয়ে থাকতে পারে রাজনৈতিক ও সামরিক ঝুঁকি– সেই উপলব্ধি থেকে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ কেউই বিদ্রোহীদের পাশে সেভাবে দঁাড়াতে চায়নি।

সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রম– ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি– যারা এই নৌবিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল। কংগ্রেসের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং মুসলিম লীগের মহম্মদ আলি জিন্না নৌসেনাদের বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের উপদেশ দিয়েছিলেন। তখন আন্দোলনকারীরা একপ্রকার বাধ্য হয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেন। নেতারা আশ্বাস দিয়েছিলেন– শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। কিন্তু তঁাদের গ্রেফতার করা হয় এবং কোর্ট মার্শাল করে ‘রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভি’ থেকে ৪৭৬ জন নাবিককে বরখাস্ত করা হয়। পরে ‘ভারত’ ও ‘পাকিস্তান’ নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও ওই বরখাস্ত হওয়া নাবিকদের কাউকেই ভারতীয় বা পাকিস্তানি নৌবাহিনীতে পুনর্বহাল করা হয়নি।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
sidmukh12@gmail.com



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *