রূপায়ণ ভট্টাচার্য
জাতীয় সড়কের হাত ছাড়িয়ে আসাম মোড় দিয়ে জলপাইগুড়ি ঢুকছি। সামান্য এগোলে বাঁদিকে আনন্দ চন্দ্র কলেজ দেখলে সোনালি অনুভূতি গ্রাস করে আজও। ওখানেই তো সাহিত্যের দুই হীরকখচিত বর্শা অমিতাভ দাশগুপ্ত-দেবেশ রায় অধ্যাপনা করেছেন দীর্ঘদিন। দুজনেই বিখ্যাত ‘পরিচয়’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সময়ে। প্রতীক হয়ে ওঠেন জলপাইগুড়ির, উত্তরবঙ্গের সাহিত্যের।
চিরকালের বামপন্থী, সুবিখ্যাত অমিতাভের একটা কবিতা ফিরে আসছে আজকের আবহে।
এবারই একশো বছরে পা দিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। নিঃশব্দেই পেরিয়ে যাচ্ছে মহাজন্মক্ষণের স্টেশন। অধিকাংশ লোকে ভুলে িগয়েছে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জনক এক খ্যাতনামা বঙ্গসন্তান। তাঁর হাতে তৈরি মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টিও। তিনি চিরকালীন মানবেন্দ্রনাথ রায়। আসল নাম-পদবি আলাদা ছিল– নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
ভারতে, বাংলায় কমিউনিজমের জনবিচ্ছিন্নতার প্রেক্ষাপটে যেন একমাত্র বেঁচে আছে কমিউনিস্ট কবিদের আত্মসমালোচনা।
নব্বই দশকে অমিতাভর কলম লিখেছিল, ‘সব সময় দলের কথা না ভেবে/ যদি মাঝে মাঝে দেশের কথা ভেবে ফেলি/আমাকে ক্ষমা করবেন, কমরেডস/পাঁচ আর সাত নম্বর ওয়ার্ডে আমাদের ভোট কম ব’লে/ সেখানকার মানুষ রাস্তা পাবে কি পাবে না জানতে চেয়েছিলাম।/ আমার জিভ কেটে নেবেন না/পার্টির ছেলে নয় ব’লে ইকনমিক্স-এ ফার্স্ট ক্লাস চন্দন/ কাজটা পাবে কি পাবে না— বলতে চেয়েছিলাম/আমার নাক ঘষে দেবেন না।/দাগি বদমায়েশ/আমাদের হয়ে উর্দি বদল করলেই/ রেহাই পাবে কি পাবে না— বলতে চেয়েছিলাম/ আমায় জুতোয় মাড়িয়ে যাবেন না/ বিশ্বাস করুন কমরেডস/ আমি দলছুট নই বিক্ষুব্ধও নই…’
কবিতার নাম ছিল ‘প্রিয় কমরেডস’। পরিস্থিতি আজও এতটাই এক, স্বচ্ছন্দে শিরোনাম পালটে দেওয়া যায়। প্রিয় দিদি হতে পারে। প্রিয় মোদিও চলতে পারে। প্রিয় রাহুল, প্রিয় বেবিও দিব্যি চলে যাবে। এবং সবচেয়ে আক্ষেপের কথা, বাম আমলে বাংলার কুখ্যাত ব্যাধি থেকে গিয়েছে আজও। কী দেশে, কী রাজ্যে!
ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে কার্যত দাবা খেলার মতো। বাংলায় যে সব ঘটনায় শিউরে উঠছি, দু’দিন পরে দেখি, দেশের অন্য প্রান্তে আরও ভয়ংকর কিছু ঘটছে। আবার ভিনরাজ্যে ভয়ংকর কিছু দেখে পাথর হয়ে যাই। দিন দুই পরেই সেই ধরনের ঘটনা দেখছি বাংলায়। সব পার্টির কর্মী বা পুলিশের দুষ্কর্মে মুখ পুড়ছে সব শাসকের শীর্ষ নেতৃত্বের।
যা দেখে দুটো সিদ্ধান্তে আসতে পারি আমরা। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে আর পাত্তাই দিচ্ছে না নীচুতলার কর্মীরা। অথবা নীচুতলার কর্মীদের ওপর আর নিয়ন্ত্রণই নেই শীর্ষ নেতৃত্বের। এখানে িদদি-মোদির সঙ্গে এক লাইনে থাকবেন যোগী-স্ট্যালিন-বিজয়ন-প্যাটেল-ফড়নবীশ-রেখা-মাঝি-নীতীশ-সিদ্দা-রেড্ডি-হেমন্ত-হিমন্ত।
এই মুহূর্তে দেশের সেরা মুখ্যমন্ত্রী কে? এই প্রশ্ন নিয়ে জনসমীক্ষা হলে কোনও সুস্পষ্ট উত্তর আসবে না। সব রাজ্য এতটাই টালমাটাল। রামরাজ্য বলে কিছু নেই আর।
ঠিক সেভাবে, এই মুহূর্তে কেন্দ্র বা রাজ্যের সেরা মন্ত্রী কে? এই মুহূর্তে বাংলার সেরা পুরসভা কোনটা? দুটো প্রশ্নে সমীক্ষা হলেও স্পষ্ট উত্তর আসা কঠিন। আমাদের দেশজ রাজনীতির পৃথিবী আবর্তিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে। সব রাজ্যেই। বাকি মন্ত্রীরা ল্যাম্পপোস্ট হয়ে উঠছেন সর্বত্র। মেয়ররা ক্ষমতাহীন এটা ভারতের নতুন প্রবণতা। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন নেই।
প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী অধিকাংশ জায়গায় প্রশাসন চালাচ্ছেন অনেক উঁচু জায়গা থেকে। ফলে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে।
অনেক ক্ষেত্রেই নীচুতলার নেতা ও মন্ত্রীরা জনতার মাথা কাটছেন জনবিচ্ছিন্ন বড় নেতাদের প্রতিনিধি হয়ে। প্রয়াত অভিনেতা-সাংসদ তাপস পাল রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দিয়েছিলেন শুধু এক কুৎসিত কথার প্রয়োগে। এই একই জাতীয় কথা বিনিময়, আচরণ এখন তৃণমূল-বিজেপির অন্দরে ঢুকে গিয়েছে সর্বত্র। তাপসকে সেজন্য অভাগাই মনে হয় এখন।
আরও অশ্লীল ভঙ্গিতে সোনারপুরে ছাত্র নেতা ইউনিয়ন রুমে ছাত্রীকে দিয়ে গা টেপাচ্ছেন। বংশীহারীতে সিপিএম নেতাকে চড় মারছেন পুলিশ অফিসার। খড়্গপুর-পানিহাটিতে রাজপথে মারমুখী কাউন্সিলার। তৃণমূল নেতৃত্ব এত বিভ্রান্ত, কোথায় কী স্ট্যান্ড নেবেন জানেন না। খড়্গপুরের বেবি কোলেকে বহিষ্কার করা হল। শাস্তি হল না বাকিদের। সম্ভবত বেবি ভদ্রমহিলার ওপর মহলে দাদা বা দিদি নেই।
যে কারণে রাজন্যা হালদারের মতো পরিচিত মুখ তৃণমূল ছাত্র নেতাদের অশ্লীল আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় প্রশ্নগুলোই ঘুরিয়ে দেওয়া হল। ধরে নেওয়া গেল, রাজন্যা বিজেপিতে ঝুঁকে, প্রচারপ্রিয়। ধরে নেওয়া গেল, তৃণমূলের ছাত্র নেতাদের আরও কাদায় ফেলতেই এই অভিযোগ। তারপরেও অনিবার্য প্রশ্ন, এইসব ঘটনায় দলীয় তদন্ত বন্ধ কেন? কেন পরপর মনোিজৎ ম্যাঙ্গোভাইদের মতো বহু ছাত্র নেতার নাম জড়ায় অশ্লীল কাণ্ডে? ছাত্র রাজনীতি যখন সম্পূর্ণ শূন্যতে, তখন এরা কারা? এদের কাজটা কী?
রাজন্যাকে নিয়ে পালটা মুখ খুলছেন তৃণমূলের মহিলা মুখমালা। খুলছেন মানে খোলানো হচ্ছে। কলকাতার মেয়র, ডেপুটি মেয়রের কন্যারা নেমে পড়েছেন বিবৃতি দিতে। যাঁর বেশি বলা উচিত, সেই শিক্ষামন্ত্রী ছাড়া সবাই বলে যাচ্ছেন। শিক্ষামন্ত্রী কলকাতায় কি না বোঝা যায়, সিনেমার শুটিংয়ের ছবি বেরোলে।
অনেকে আবার আগ বাড়িয়ে বলে বিপদে ফেলছেন মমতা-অভিষেককেই। টালিগঞ্জ পাড়ার এক নম্বর খলনায়ক স্বরূপ বিশ্বাসের স্ত্রী জুঁই কাউন্সিলার। তিনি যা বলছেন, তা আসলে মমতা-অভিষেককেই চ্যালেঞ্জ। নিজের সামাজিক মাধ্যমে জুঁই লেখেন, ‘যোগ্যতা বিচারের জন্যও যোগ্যতা লাগে। যারা একে মাথায় তুলেছিলেন, তাদের যোগ্যতা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। না নেত্রী হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে, না অভিনেত্রীর। দু’দিন এসেই নেত্রী?’
রাজন্যাকে ২১শে জুলাই মঞ্চে তোলার চূড়ান্ত নির্দেশ ছিল িনশ্চয়ই মমতা বা অভিষেকের। তাঁদের যোগ্যতা নিয়েও কি প্রশ্ন রয়েছে স্বরূপ-পত্নীর? তাঁর পোস্টেই দেখলাম একজন লিখেছেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তদন্তের আদেশ এলেও স্থানীয় প্রশাসনে তা মান্যতা পায় না। এদের যে জমি ও বাড়ি পছন্দ হবে, তা বহুতলের জন্য দিতে হবে।’ নিউ আলিপুর অঞ্চলে এসব বহুদিন শোনা যায়। মমতা-অভিষেক জানেন না, বললে হবে?
কাণ্ডজ্ঞানহীনরা দায়িত্ব পেলে এমনই হয়। গ্রামের দিকে স্ত্রীকে প্রধান বা জেলা পরিষদ সদস্য করে আসলে চাবিকাঠি নিয়ে বসে থাকে পুরুষতন্ত্র। কলকাতার দিকেও এখন এমন হচ্ছে। মনোজিৎ ম্যাঙ্গোভাইয়ের কৃতিত্ব হল, একটি ধর্ষণ করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, জোড়াফুলের এত এত ছাত্র নেতা ঘাপটি মেরে লুকিয়েছিল চারদিকে। ছাত্র নির্বাচন তো বহু বছর বন্ধ, এরা কী কাজ করে কলেজে?
অমিতাভ দাশগুপ্ত ওই কবিতার শেষ দিকে লিখেছিলেন, ‘অবিশ্বাস আর ঘৃণার/ ছোট ছোট দরজা জানালা ভেঙে/ আমরা কি একবারের জন্যেও/ সেই বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর গিয়ে দাঁড়াতে পারি না/ যেখানে/সূর্যের আলো/ সব জায়গায় সমানভাবে এসে পড়ে?’
এত বছর পরেও আমরা বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর দাঁড়াতে পারিনি। বসে আছি ছোট ছোট, অন্ধকার ঘরে। অবিশ্বাস ও ঘৃণার ছোট ছোট দরজা জানলা ভাঙতে পারিনি। সব জায়গায় সমানভাবে সূর্যের আলো পড়বে কী করে?