অবিশ্বাসের পাঁকে পতন

অবিশ্বাসের পাঁকে পতন

ব্লগ/BLOG
Spread the love


আপ ধরাশায়ী হওয়ায় চর্চায় এসেছে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না করার প্রসঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলছেন, কংগ্রেসের হাত না ধরা কাল হয়েছে আম আদমি পার্টির। যদিও তাঁর দল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। তখন তৃণমূল নেত্রী বা তাঁর দল এই সতর্কবাণী কিন্তু আপ নেতৃত্বকে দেননি। ভোটের পরিসংখ্যান দেখে মমতাও বলছেন, আপ-কংগ্রেস সমঝোতা হলে অন্তত ১৪টি আসন পদ্মচিহ্নে চলে যেত না।

এই বিশ্লেষণ পুরোপুরি বেঠিক নয়। কিন্তু আপের পরাজয়ে এই বিশ্লেষণটি যথার্থ নয়। কারণ আরও অনেক আছে। প্রথমত, কবিতায় সেই নীতি পংক্তি স্মরণে আনা যেতে পারে- ‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নিজের সম্পর্কে বড় ভাবনা ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরিয়েছিল।

গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেলেও মুখ্যমন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেননি তিনি। আবার জামিনে মুক্ত হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়েছিলেন। কেজরিওয়ালের ভাবনায় ছিল, তিনি যা করবেন, বিনা বাক্য ব্যয়ে দিল্লির জনতা তাতে সমর্থন জোগাবে। বাস্তবে এই আত্মম্ভরিতার জবাব দিয়েছেন দিল্লিবাসী। যেমন দলের একাংশের ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে ২০১১-তে সিপিএম সরকারকে জবাব দিয়েছিল বাংলার মানুষ। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হিসাবে যে আপকে ক্ষমতায় এনেছিলেন দিল্লিবাসী, সেই দুর্নীতির অভিযোগে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া কাল হল।

দুর্নীতির সেই অভিযোগ কতটা ঠিক, তা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। দুর্নীতির পাকে আপকে জড়িয়ে দেওয়ার পিছনে ষড়যন্ত্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু আপ নিজেকে কলঙ্কমুক্ত প্রমাণে বিশ্বাসযোগ্য কিছু সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতি সাফ করতে যে ঝাঁটার আবির্ভাব, তাতে জড়িয়ে গিয়েছিল কেলেঙ্কারি। দলের নির্বাচনি প্রতীক ঝাঁটা সেই কলঙ্ক সাফ করতে না পারায় আপের ওপর আস্থা কমেছে ধীরে ধীরে।

কোটি কোটি টাকা খরচে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঢেলে সাজানোয় যে শিশমহল বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার সুযোগ করে দিয়েছে আপ সরকারই। দুর্নীতি বিরোধী চ্যাম্পিয়নের তকমা থাকা সত্ত্বেও এই অভিযোগের গ্রহণযোগ্য উত্তর মানুষের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছেন কেজরিওয়াল-সিসোদিয়ারা। তৃতীয়ত, লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করার পর বিধানসভা ভোটে একাই একশো ঢংয়ে কেজরিওয়ালের আস্ফালন বিজেপি বিরোধী মানুষ বিশ্বাসযোগ্য মনে করেনি।

শাহিনবাগ আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রাখা, দিল্লিতে দাঙ্গার সময় নীরবতা, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব ও কৃতী ছাত্রদের দিনের পর দিন আটকে রাখার প্রতিবাদ না করা ইত্যাদি ওই ধরনের ভোটারদের মনে অবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল আগেই। একা লড়ার ঘোষণা সেই অবিশ্বাসের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। এতে যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোট বাঁধা ছিল, তা আপের বাক্স ভেঙে এই নির্বাচনে বেরিয়ে গিয়েছে।

চতুর্থত, যমুনার জল হরিয়ানা দূষিত করে পাঠাচ্ছে জাতীয় বালখিল্য মন্তব্য কেজরিওয়ালের প্রতি শিক্ষিত মানুষের বিতৃষ্ণা তৈরি করে দিয়েছে। উলটে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও দিল্লির জলসমস্যা প্রতিকারে দিল্লি সরকারের ব্যর্থতা আর পাঁচটা দলের সঙ্গে আপের পার্থক্যকে ঘুচিয়ে দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, রং আলাদা হলেও অন্য দলের থেকে আপের কোনও ফারাক নেই। দিল্লিবাসীর তাই ভরসা টুটেছে।

পঞ্চমত, আপ আসলে কোনও রাজনৈতিক দলই নয়, একটি মঞ্চ মাত্র। আন্না হাজারের নেতৃত্বে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যার জন্ম। দল নয় বলে, আপের কোনও সংগঠন নেই। এতদিন আবেগে ভর করে নির্বাচনি সাফল্য পেয়েছে। অন্য দলগুলির সঙ্গে পার্থক্য ঘুচে যাওয়ায় সেই আবেগ উধাও হয়ে গিয়েছে মানুষের মন থেকে। ব্যক্তিনির্ভর দল তৃণমূলও। কিন্তু দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। আপের বিরাট খামতি সেখানে। সংগঠনহীন দলের পরিণতি এমনই হয়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *