অবান্তর স্মৃতির ভিতর আলো-আঁধারি ছবি

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আলো-আঁধারি ছবি

শিক্ষা
Spread the love


  •  অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

দিনকয়েক আগে, সন্ধ্যায় শহরের এক গলি দিয়ে হেঁটে ফেরার সময়, হঠাৎই কানে এল হারমোনিয়াম বাজিয়ে কচি গলায়, ‘আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবনভরা’। আর কী আশ্চর্য, তক্ষুনি ঝুপ করে রাস্তার আলোগুলো গেল নিভে। না, নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নয়; চারপাশের দোতলা, তিনতলা বাড়ি ও ফ্ল্যাটগুলো থেকে জানলা দিয়ে আসা ইনভার্টারের আলো রাস্তায় পড়েছে। দুজন পথচারী বলতে বলতে গেলেন “লোডশেডিং নাকি! রাস্তার আলোগুলো জ্বলে না কেন?” উড়ে আসা কথাগুলো, হালকা আলো আর বৃষ্টিতে কামিনী ফুলের ভেসে আসা গন্ধ হঠাৎ যেন টাইম মেশিনে করে নিয়ে গেল অনেক পিছনের দিনগুলোয়–সেই সত্যিকারের লোডশেডিং-এর সময়ে। হ্যাঁ এখন আর ‘লোডশেডিং’ হয় না, যা হয় তা প্রযুক্তিগতভাবে ‘পাওয়ার কাট’। আশি বা  নব্বই-এর দশকে স্কুল-কলেজ কাটানো বাঙালির স্মৃতিচারণ মানেই সেই ঘুটঘুটে দিনগুলোর ঝলমলে রোমন্থন। মালদা থেকে মেদিনীপুর বা জলপাইগুড়ি থেকে জয়নগর, মফফসল বা শহরের দৃশ্যগুলি মোটামুটি একই। এই ইনভার্টার, মোবাইলে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া আমাদের মাঝবয়সি প্রজন্মও এখন আর ভাবতে পারি না আলোপাখাহীন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো সময়গুলো! হাতের মুঠোর নীল পর্দাটির সৌজন্যে পৃথিবীতে বহু কিছুর মতোই বিশুদ্ধ অন্ধকার বলেও আর কিছু নেই।

অবধারিত পূর্ণেন্দু পত্রীকে মনে পড়ে যায়—

“মাঝে মাঝে লোডশেডিং হোক।/আকাশে জ্বলুক শুধু ঈশ্বরের সাতকোটি চোখ/ বাকী সব আলকাতরা মাখুক।/ আমরা নিমগ্ন হয়ে নিজস্ব চশমায় আর দেখি না কিছুই/সকলে যা দেখে তাই দেখি।/আকাশের রঙ তাই হয়ে গেছে চিরকালে নীল।/বাতাস কী শাড়ি পরে কারো জানা নেই।”

ঠিক তাই। লোডশেডিং মানেই ছিল আকাশ দেখা— শিউলি ফুল ছড়িয়ে থাকার মতো তারাভরা রাতের আকাশ। সন্ধ্যার দু’এক ঘণ্টার প্রাত্যহিক লোডশেডিং-এর প্রস্তুতি থাকত সব বাড়িতেই বিকেল থেকে। উনুনের ঘুঁটের ছাই দিয়ে চিমনি বা লন্ঠনের কাচ মেজে ঝকঝকে করে তাতে কেরোসিন তেল ভরে, পোড়া সলতে কেটে ঘর বা বারান্দার কোণে গুছিয়ে রাখা হত। সেগুলোর মধ্যেই একটা জ্বালিয়ে আগুন স্তিমিত করেই রাখা থাকত, যাতে আচমকা অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে না হয়। এক-আধটা কুপিও ছিল উঠোন পেরোনো বাথরুম বা রান্নাঘরে যাওয়ার জন্য। প্রয়োজনীয় কেরোসিনের জন্য র‌্যাশন দোকানে সাপ্তাহিক লাইনও  দৈনন্দিনতার অঙ্গই ছিল ভদ্রবিত্ত ঘরে। সন্ধেয় শাঁখ বেজে ওঠার আগেই খেলার মাঠ থেকে ঘরে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসা বা গলাসাধার বরাদ্দ রুটিনে যুক্ত হতে না হতেই ঝুপ করে লোডশেডিং আর পাড়াজুড়ে হোওওওওওওও করে আওয়াজ! সচেতন মা-কাকিমারা তক্ষুনি হাজির লন্ঠন, চিমনি হাতে, বাড়ির কোনায় কোনায় মোমবাতি কুপিদের জ্বলে ওঠায় নিত্য দেওয়ালি! যৌথ পরিবারের ছয় ভাইবোনের ঋতু অনুযায়ী  ব্যবস্থা। হয় ঠাকুমার বিরাট খাটের ওপর  বা মেঝেতে মাদুর, শীতলপাটিতে গোল হয়ে বসে মধ্যিখানে আলো রেখে পড়াশোনার নামে রাজ্যের খুনশুটি!

দেওয়ালে কত রকমের ছায়া আর আলো ঘিরে নানারকম পোকার দল! পড়ার নামে নালিশ মারামারি — ‘এই বড়দি দেখ তোর নাকের ছায়াটা দেখ, একদম পিরামিডের মত! হি হি! ও মা দেখো তো বুনু আমার গায়ে লন্ঠনের কালি দিল!! শুরু হয়ে গেল নালিশ? ওই মেজদি, তুই আলোটা তোর দিকে ঘোরালি কেন রে? বেশ করেছি! জানিস না আমার চোখে মাইনাস পাওয়ার? হ্যাঁ তোর বুদ্ধিও তো মাইনাস, জানি তো! এই চুল টানবি না একদম! উফফ ভাই একটু আস্তে পড় না, তোর ভূগোলের চোটে তো আমার অঙ্ক  মাথায় ঢুকছে না! কী রে আরও জোর চ্যাঁচাচ্ছিস কেন? ও মা আমার গায়ে ছোড়দি কী একটা পোকা ধরে ছেড়ে দিল!’

‘অনেক হয়েছে বন্ধ করো তোমরা এই পড়াশোনার নাটক’, এটুকু শোনার অপেক্ষা। ব্যাস, বইখাতা ফেলে হইহই করে দলবেঁধে ছাদে। ছাদে ছাদে গল্পগাছা গানের লড়াই। রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে শুরু হয়ে যা অবধারিত ‘চোখের জলের হয় না কোনও রঙ’ ছুঁয়ে ‘পাপা কহতে হ্যায়’ বা ‘কবুতর যা যা’ তে গিয়ে শেষ হত। মাদুর পেতে মায়ের পাশ ঘিরে শুয়ে পড়তাম আমরা গুটিশুটি। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে মা গাইত ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে’! ভেজা চোখ মায়ের কোলে লুকিয়ে ফেলে শুনতে শুনতে আচমকা আকাশের দিকে তাকালে স্পষ্ট দেখতাম সাদা ডানার পরি নাকি পক্ষীরাজ নেমে আসছে। লেবু ফুলের গন্ধ, তক্ষকের খক খকের মধ্যে, নারকেল পাতার ফাঁকে আচমকা রাতদিন গুলিয়ে ফেলে ডেকে ওঠা কাক— কাকজ্যোৎস্না! কাকেরাও আজকাল ডিজিটাল হইয়াছে বটে, আর এমন ভুল করে না। আবার হোওওওওও করে চিৎকারে জ্যোতিবাবু এসে গেছেন ঘোষণায় সভাভঙ্গ! আলো চলে আসায় এমন দুঃখ পাওয়া ভাবলে এখন তাজ্জব লাগে। লম্বা উঠোনের ওপর বারান্দার থামের ছায়া পড়লে আলোছায়া খেলা কেউ খেলে কি এখন? ছায়া থেকে ছায়ায় টপকে যাওয়ার মাঝে আলোর মধ্যে ছুঁয়ে দিলেই আউট!

প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে “আমাদের স্বর্গ না থাক সারিডন আছে”র মতো লোডশেডিং স্বর্গসুখ ছিল বটে। অকালপক্ব বন্ধুরা স্কুলে গিয়ে সে সব অন্যরকম ছোঁয়াছুঁয়ি খেলার নিষিদ্ধ গল্প শোনালে কী রোমাঞ্চ! ছিঁচকে চোরেদেরও স্বর্গসুখ ছিল তখন। ক্লাস নাইনে আমাদের বাড়ির সঙ্গেই পাড়ায় একাধিক বাড়িতেই ইমার্জেন্সির আগমন হলে অনেকরকম ফাঁকিবাজির ইতি। কিন্তু লোডশেডিং-এ বাড়ির পিছনের বাগান, পুকুর বা বাঁশঝাড়ের রহস্যময়তা তাতে এতটুকু কমেনি। ভরা বর্ষার লোডশেডিং মানে আবার ভূতুড়ে গল্পের ঝুলি খুলে বসা রাত!

লোডশেডিং ক্রমে বিরক্তিকর হয়ে ওঠার বয়সে অবাক হয়ে ভেবেছি অসুবিধে নিয়েও কতটা আদিখ্যেতা থাকলে ‘লোডশেডিং চুড়ি’ বা ‘লোডশেডিং শাড়ি’র আমদানি হতে পারে বাজারে! সাদাকোলো দূরদর্শনের ধারাবাহিক বুনিয়াদ, ক্রিকেট ফাইনাল বা চিত্রহার না দেখতে পাওয়ায় উত্তেজিত হয়ে ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই অফিসে ফোন করে পিতৃমাতৃকুল উদ্ধার করে দেওয়া পাবলিকও কিছু কম ছিল না। বাজার চলতি রসিকতা চলত বন্ধুমহলে লোডশেডিং ঘিরে যেগুলোর পলিটিকাল কারেক্টনেস নিয়ে মাথা ঘামানোর বোধবুদ্ধি কারও বিশেষ ছিল না। এই যেমন লোডশেডিং-এর সময় কন্যার বাবা গানের গৃহশিক্ষককে বলছেন, “মাস্টার তবলা যেন না থামে!”

লোডশেডিং-এর সেই যুগ আসলে একটা নির্দিষ্ট সময়, একটা এমন প্রজন্মের সময় যারা একটা টানা দৌড়ের শেষে এসে পড়েছে ঝাঁ চকচকে ডিজিটাল দুনিয়ায়, যেখানে ঘুমের মধ্যেও শুদ্ধতম অন্ধকার নেই, কারণ ঘুমই নেই। আর তাই ফিরে যাওয়া আছে সেই সময়ের স্মৃতিময়তার কাছে যার সবটাই সত্যিকারের সুখকর আদপে ছিল না। এইসব স্মৃতিচারণ লিখতে বসে টের পাই এগুলো আসলে বিত্তে কিছুটা এগিয়ে থাকা ভদ্রজনের বিলাসিতা। যাঁদের সঙ্গে সারাদিন থাকি, সেই বাচ্চাদের অধিকাংশের মতো আরও অনেক বাড়িতে যাদের কখনও বৈদ্যুতিক আলোই ছিল না,  বা আজও নেই- সেইসব ঘর থেকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা মুখগুলোর জন্য এ লেখা মানেই রাখে না। ওদের অনেকের সামনেই যখন দাঁড়াই, তখন ভাবি লোডশেডিং আর পাওয়ার কাটের তর্কের আড়ালে আসলে সত্যিকারের অন্ধকার দূর হতে অনেক পথ হাঁটা বাকি। লোডশেডিং ঘিরে ওপরের গোটা লেখাটাই আলোর বৃত্তে দাঁড়িয়ে অন্ধকারকে দেখা হয়ে যায়। উলটোদিকের গল্পগুলো কুড়োতে থাকি নতুন করে লিখব বলে।

The submit অবান্তর স্মৃতির ভিতর আলো-আঁধারি ছবি appeared first on Uttarbanga Sambad.



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *