তখনও ভালো করে আলো ফোটেনি। দিল্লিতে এমনিতেই সকাল হয় দেরিতে। ঘুম থেকে উঠে শুনলাম, সামনের ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে এক অধ্যাপককে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। এমারজেন্সির সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। বলা ভালো, গোটা মহল্লার। তার আগে রাতের গভীরে এমনভাবে কাউকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে দেখেনি কেউ।
তখন স্কুলে পড়ি। খুব বেশি কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝতাম, সবকিছু অনেকটা বদলে গিয়েছে। রাস্তাঘাটে বিশেষ একটা কথা বলত না কেউ। বাস থেকেও পুলিশ নামিয়ে নিত লোকজনকে। কে যে সাদা পোশাকের পুলিশ কে বলতে পারে! তাই মুখে কুলুপ। সর্বত্র। তার আগে একদিন স্কুল থেকে সরকারি বাসে চাপিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল শিবাজি স্টেডিয়ামে। সেখানে ভাষণ দিলেন ইন্দিরা গান্ধি। কী বলেছিলেন এখন আর মনে নেই। নিশ্চয়ই অনেক ভালো ভালো কথা।
আর মনে আছে, কনট প্লেসের সাদা থামে বড় বড় পোস্টার সাঁটা। তাতে জয়প্রকাশ নারায়ণের ছবি। তাঁকে ডলার দিচ্ছে একটা হাত। সঙ্গে কী লেখা ছিল মনে নেই। তবে লোকটা যে খুব খারাপ এমন কিছুই হবে। ওই বয়সে অতশত না বুঝলেও ইন্দিরা পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ তৈরি করেছেন বলে গোড়ার দিকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাই দেখতাম লোকের। আর জরুরি অবস্থা যে কী তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণাও ছিল না কারও। শুধু যেদিকে তাকাতাম চোখে পড়ত বিনোবা ভাবের বাণী বড় হরফে লেখা, আপাৎকাল অনুশাসন পর্ব হ্যায়।
তো সেই অনুশাসন পর্বে তারই মধ্যে ইন্দিরার বিশ দফা আর তাঁর ছোট ছেলের পাঁচ দফা নিয়ে বিস্তর হইচই চলত। ছিল নাসবন্দি নিয়ে ফিশফিশ আলোচনা। কোথায় কোথায় জোর করে নিবীর্যকরণ চলছে তা নিয়ে তলে তলে প্রচার। জরুরি অবস্থা জাঁকিয়ে বসার পর রাজধানীতে দেখতাম সঞ্জয় গান্ধি এবং তস্য চেলাদের বিপুল দাপট। তখন খুব শুনতাম অম্বিকা সোনি, সজ্জন কুমার, এইচকেএল ভগত, জগদীশ টাইটলার, কমল নাথের নাম। ততদিনে পা রেখেছি কলেজে। সেখানে ক্যাম্পাসে বরং বাইরের থেকে তুলনায় উত্তাপ ছিল বেশি। জয়প্রকাশের বক্তৃতা শুনেছি তখন ক্যাম্পাসে। পালটা যুব কংগ্রেসের মিছিলও হত। গোটা ক্যাম্পাস ছেয়ে গিয়েছিল প্লেন ড্রেসের পুলিশে। তারা সারাদিন আমাদের গায়ে গায়ে বসে কমিউনিস্ট দেশবিরোধীদের খোঁজার চেষ্টা করে যেত। কেউ বেফাঁস কিছু বলছে কি না তা কান খাড়া করে শুনত তারা। তবে দিল্লিতে বহু ভাষাভাষী ছাত্রছাত্রী পড়ে। তাই কথার মর্ম উদ্ধার করতে যে তাদের ঘাম ছুটত সেটা বুঝতে অসুবিধে হত না তাদের দেখলে। আমরা বাঙালিরা খুব উপভোগ করতাম তাদের হতভম্ব হতে দেখে। নিজেদের মধ্যে কথা চালাতাম মাতৃভাষায়। বোঝে কার সাধ্যি।
আর কলেজে কলেজে দলবল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন রুকসানা সুলতানা নামে হঠাৎ উঠে আসা এক মহিলা। কে তিনি, পরে কোথায় বা গেলেন কে জানে! এটুকু সবাই জানত, তাঁর হাতে বিপুল ক্ষমতা। তিনি কী বলতেন তাতে কারও মাথাব্যথা দেখিনি। রুকসানা ছিলেন ডাকসাইটে সুন্দরী। তিনি ছিলেন সঞ্জয় গান্ধির খাস লোক। তাঁকে নাকি মুসলিম এলাকায় নিবীর্যকরণের প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
সঞ্জয়ের পাঁচ দফায় ছিল বনসৃজন আর দিল্লির সৌন্দর্য বাড়ানো। ফলে শুরু হয়েছিল বস্তি উচ্ছেদ। যে রাস্তা দিয়ে কলেজে যেতাম সেখানে পথের ধারে ছিল বিরাট বস্তি। একরাতের মধ্যে তা সাফ হতে দেখেছি। পুরো এলাকা পুলিশ দিয়ে ঘিরে রামলীলা ময়দানের গায়ে তুর্কমান গেটে বাড়ি ভাঙাও দেখেছি। তা নিয়ে ব্যাপক গণ্ডগোল হয়েছিল। পুলিশের গুলিতে কম করেও কুড়িজন মারা গিয়েছিলেন। কাছেই আম্বেদকর স্টেডিয়ামে ডুরান্ড কাপ ফুটবল দেখতে গিয়ে দেখেছিলাম দলে দলে লোকজন বেরিয়ে আসছেন। পিছনে পুলিশের গাড়ি। বাইরের লোক কিছুই জানতে পারেনি, কারণ এসব খবর সেন্সরের কাঁচিতে ছাঁটাই হয়ে যেত।
সবকিছুই প্রতিরোধহীন। নেতারা প্রায় সবাই জেলে। খবরের কাগজ সেন্সর করা, সেখানে বড় বড় করে ইন্দিরা, সঞ্জয়ের ভাষণ ছাপা হত। জেলে পোরা হয়েছিল সাংবাদিকদেরও। এককথায় স্বাধীন দেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এখনও যা ক্ষত হয়ে রয়েছে, থাকবেও। আগামীকাল পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করছে জরুরি অবস্থা। তখন মানুষের মুখ বন্ধ ছিল। তারপর প্রথম সুযোগে তার বদলা নিয়েছিল তারা। কংগ্রেসকে গোহারা হারিয়ে দিয়েছিল। আজ যদি বুলডোজাররাজ দেখে কারও সেদিনের কথা, স্ট্যান স্বামী থেকে উমর খালিদদের হাল দেখে সেদিনের জেলে বিনা বিচারে বন্দি নেতা-কর্মীদের কথা মনে পড়ে তা কি খুব সুখের হবে? তখন ছিল মিসা। এখন ইউএপিএ। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা তখনও কয়েদ করার যুক্তি ছিল।
সে সময়ের একটা খুব চালু স্লোগান ছিল, সচ কহনা অগর বগাবত হ্যায়/তো সমঝো হুম ভি বাগি হ্যায়। সত্যি বলা যদি বিদ্রোহ হয়, তবে ধরে নাও আমিও বিদ্রোহী। সত্যি বলার সাহস, সত্যি শোনার সহিষ্ণুতা যখন ফুরিয়ে যায় তখন ঘটা করে জরুরি অবস্থার জন্য শোক দিবস পালন একটা নিষ্ঠুর পরিহাসের মতো শোনায়। পঁচাত্তর সালে কাগজে-কলমে ৩৫৬ ধারা জারি হয়েছিল রাষ্ট্রপতির সই নিয়ে। কিন্তু অঘোষিত জরুরি অবস্থা তার থেকে বহুগুণ বেশি ভয়ংকর। তখন গণতন্ত্রের মুখোশ এঁটে সংবিধানকে গলা টিপে মেরে ফেলা কত সহজ, তাই না?