অতীতের হীরক রাজার মতো সর্বকালের সমস্ত শাসক চান, প্রজা, সভাসদ, পণ্ডিত সবাই যেন তাঁদের সুরে সুর মেলান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শান্তা দত্ত উলটো পথে হেঁটে শাসকের রোষানলে পড়েছিলেন। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) প্রতিষ্ঠা দিবসে নির্ধারিত পরীক্ষার দিন বদলে ফেলতে প্রশাসনিক, এমনকি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধও তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। পরিণামে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের অকালপক্ব নেতাদের কুৎসিত ভাষা, গালাগাল শুনতে হয়েছে তাঁকে।
যদিও উপাচার্য নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে নির্ধারিত সূচি মেনে টিএমসিপি’র প্রতিষ্ঠা দিবসেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন। এই সিদ্ধান্তকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে কথিত স্বশাসনের জয় বলে দাবি করেছেন উপাচার্য। তাঁর মতে, অন্যায়ের সঙ্গে তিনি আপস না করায় ৯৬ শতাংশ পরীক্ষার্থী নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে যাতে আর পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ শাসকদলের কাছ থেকে না আসে- সেই আর্জিও জানিয়েছেন উপাচার্য।
শাসকের চোখে চোখ রেখে চলার মতো মেরুদণ্ডের জোর অনেকেরই থাকে না। পশ্চিমবঙ্গ হোক কিংবা দেশের অন্যত্র, শাসকের ইচ্ছায় কর্মের উদাহরণ ভূরিভূরি। তার মধ্যেও এরকম ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনায় স্পষ্ট, এখনও মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে যায়নি, এখনও সকলে শাসকের কাছে মেরুদণ্ডকে বিকিয়ে দেননি। যে অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসূচি বদলানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, সেই অনুষ্ঠানে সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজে ধর্ষণের নিন্দায় একটি শব্দও উচ্চারিত না হওয়ায় সংগত প্রশ্নই তুলেছেন উপাচার্য।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা সত্ত্বেও টিএমসিপি প্রতিষ্ঠা দিবসের সভায় সংগঠনের ওই নেতাদের তিরস্কার না করার প্রসঙ্গও তুলেছেন শান্তা দত্ত। উপাচার্য মনে করেন, তিনি থাকুন বা না থাকুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন চিন্তার জয় হয়েছে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা হওয়ায়। মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করা যে ইদানীং কঠিন হয়ে পড়ছে, সেটা গোপন কথা নয়। মাথানত না করে কাজ করার উদাহরণ যাঁরা বাংলায় রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে আরেক উদাহরণ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্য নির্বাচনি আধিকারিক মীরা পান্ডে। শান্তা দত্তের আগে তিনিও রাজ্য সরকারের চোখে চোখ রেখে কাজ করেছিলেন। রাজ্য সরকারের চাপের মুখেও অবস্থান বদলাননি।
শান্তা দত্ত, মীরা পান্ডেদের নজির সকলে অনুসরণ করলে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এতটা শোচনীয় হত না। আরজি কর থেকে সাউথ ক্যালকাটা ল’ কলেজ, অন্যায়ের সীমা পেরিয়ে যেত না। জয়েন্ট এন্ট্রান্সে ফল প্রকাশে বিলম্ব, ডিগ্রি কলেজগুলিতে স্নাতক স্তরে অসংখ্য আসন খালি পড়ে থাকা, মেধাবী পড়ুয়াদের দলে দলে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়া ইত্যাদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্দশা কোথায় পৌঁছেছে।
আখেরে ক্ষতি হচ্ছে বাংলার পড়ুয়াদের। কিন্তু সেজন্য পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরের উদ্বেগ থাকার কোনও লক্ষণ নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সরকারের চাপের সামনে মাথানত করে পরীক্ষা স্থগিত করে দিয়েছে। অপরদিকে, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের অধ্যক্ষ নিজে টিএমসিপি সদস্যদের পোশাক বিতরণ করেন এবং নিজেও জয় বাংলা লেখা পাঞ্জাবি পরেন।
শান্তা দত্ত যে দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছেন, তা পারেননি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের অধ্যক্ষ। শাসক চায় প্রশ্নাতীত আনুগত্য। নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে বহু মানুষ সেই আনুগত্য স্বীকার করে আপসের রাস্তায় হাঁটেন। মাথা নোয়াতে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে শাসক ধরেই নেয় যে, সে সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে। এতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হবেই।
একটা সময় পশ্চিমবঙ্গে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল কংগ্রেসের। সিপিএমের ৩৪ বছরের দুর্গ ছিল। দুটি দলই পশ্চিমবঙ্গে শূন্য হয়ে গিয়েছে। সেই উদাহরণ মনে না রাখলে বিপদ হতে কতক্ষণ বর্তমান শাসকদলের।