সুপ্রিয় দেব রায়
ভাদ্দর মাসের তাল পাকা আর অভদ্র প্যাচপেচে গরম সইবার সাহস যেন দেখায় শরতের নীল আকাশে পেঁজা পেঁজা শুভ্র তুলোর মতো ভেসে থাকা মেঘের ভেলা, নদীর তীরে, মাঠে-প্রাঙ্গণে শুভ্রসাদা কাশফুলের খিলখিল হাসি আর শরতের ভোরে উঠোনে বিছানো মাদকতাভরা ম-ম সুগন্ধে শিউলি ফুলের শামিয়ানা। হৃদয়ে ভেসে বেড়ায় তিরতিরে সুখ-বাতাসের অনুভূতি।
ঘুমকাতুরে কন্যাটি ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে একছুটে সাজি নিয়ে চলে যায় শিউলি গাছের তলায়। স্মৃতির পর্দায় বধূ দেখতে পান নিজেকেই। দ্বিপ্রহরে সংসারের জাঁতাকলে ঘেমেনেয়ে ব্যতিব্যস্ত বধূটি নিঃশ্বাস নিতে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালে মাথার ওপর বেখেয়ালে উড়ে যাওয়া মেঘের খেয়া ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের পুজোয়।
মেঘের কোল ঘেঁষে ভেসে আসে সুখময় শৈশবের স্মৃতি খেয়া, ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা / নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা…।’ অফিসের কাজের ফাঁকে বাবুটিরও চোখ চলে যায় আকাশের দিকে জানলার কাচ ভেদ করে। ভুলে যান ল্যাপটপে অসমাপ্ত ফাইলটির কথা, কিবোর্ডে অজান্তে থেমে যায় আঙুলগুলো।
মনে পড়ে যায়, বাবা-মায়ের আঙুল ধরে হেঁটে যাওয়া এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে। পায়ে ফোসকা নিয়ে। নতুন জুতো পরার কল্যাণে। ফোসকা পায়েই আবার ছোটা পুজোমণ্ডপে পরেরদিন সকাল হতে না হতে। হিসেব দিতে হবে যে বন্ধুদের, কে ক’টা ঠাকুর দেখেছে কাল। আজকের খোকা-খুকিরা অবশ্য বেশি উৎসাহী প্রতিমার সঙ্গে সেলফি তুলতে। প্রতিমা দর্শনের চেয়ে স্ট্যাটাস আপডেটেই বেশি আগ্রহ।
আনন্দটা বড্ড হিসেব করে আসে। লাগামছাড়া গলা জড়াজড়ি ভালোবাসার অভাব। অফিসফেরতা ট্রেনে গাদাগাদি ভিড় আর ঘর্মাক্ত শরীরে কিন্তু ক্লান্তি নেই পুজোর বোনাসের আলাপচারিতায়। সারা ট্রেনজুড়ে যেন পুজো পুজো গন্ধ। বাদাম-ছোলার ফেরিওয়ালাদেরও ক্লান্তি নেই। সকাল থেকে গভীর রাতের লাস্ট লোকাল পর্যন্ত টহল। পৌঁছোতে হবে যে তাঁদের নিজের তৈরি লক্ষ্যে। বাচ্চাদের পুজোর জামা কিনে দেওয়ার লক্ষ্য।
পথের ধারের ফুচকা, আলুকাবলি আর এগরোল বিক্রেতাদের মনে কাশফুলের মতো খুশির দোলাদুলি। আর তো কয়েকটা দিন, বিক্রি হবে কয়েকগুণ। গৃহকর্মীদের মুখে খিলখিল হাসি, পুজোর বোনাস আর নতুন শাড়ি প্রাপ্তিতে। কর্তা-গিন্নি-ছেলেপুলে সবাই মিলে খাবেন ভোগখিচুড়ি। আর রাতে নামী দোকানে অর্ডার দিয়ে বিরিয়ানি কিংবা কষা মাংস আর রুমালি রুটি।
এসেই গেল প্রায় পুজোর ছুটি। প্রাণে পুলক। যে পুলক শুধু প্রতিমা দর্শন, পুষ্পাঞ্জলি, নতুন জামা কিংবা নতুন শাড়ির জন্য নয়। এই আনন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রবাসী বাঙালির ঘরে ফেরা, আত্মীয়স্বজন, শৈশবের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটানোর লোভ। এই টান, এই আকুতির জন্য দুর্গাপুজোর সঙ্গে জুড়ে থাকে পার্বণের উচ্ছ্বাস।
আজও যে টিকে আছে মণ্ডপে নতুন শাড়িতে কিশোরীদের কলতান, পাটভাঙা পাঞ্জাবি আর নতুন শাড়ির খসখস আওয়াজে পুষ্পাঞ্জলি। যতই আজকালের বাচ্চারা, কিশোর-কিশোরীরা সারা বছর নতুন জামাকাপড় আর উপহার পাক, পুজোর কাপড় আর উপহারে আলাদা আকর্ষণ আর উত্তেজনা। তাই শিউলির মাদকতাভরা পুজোর সকাল, পুষ্পাঞ্জলি, ভোগখিচুড়ি, বালখিল্য খিলখিল হাসি আর ছোটাছুটিতে উদ্ভাসিত হয় মণ্ডপ প্রাঙ্গণ।
বয়স অনুযায়ী ভাগ হয়ে দলে দলে আড্ডা, সন্ধ্যায় প্রতিমা দর্শনের সঙ্গে এগরোল আর ফুচকা খাওয়া– এসব চিরন্তন, যার তফাত হয় না কালে কালে। পুজোর দিনগুলি সবার কাছে হিরের মতো। হিরে পুরোনো হলেও তার ঔজ্জ্বল্য কখনও ম্লান হয় না। একটু ঘষলেই, পালিশ করলেই চিরনূতন। চিরনূতন অনুভূতি।
(লেখক প্রাবন্ধিক, বারাসতের বাসিন্দা)