‘রাজনৈতিক লড়াই জনগণের ময়দানে হোক। আপনারা কেন ব্যবহৃত হচ্ছেন?’ শীর্ষ আদালতের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে এবার ইডি-র কর্মকাণ্ড।
সোমবার সুপ্রিম কোর্ট এক তাৎপর্যপূর্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ফের স্পষ্ট করে দিয়েছে: আইনের হাতিয়ার ব্যবহার করে যেন রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে লড়াই না চালানো হয়। কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ‘এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট’-এর (ইডি) ভূমিকা নিয়ে শীর্ষ আদালতের এই তীব্র ভর্ৎসনা শুধু একটি মামলায় আবদ্ধ নয়, এটি একটি বৃহত্তর প্রশ্ন তোলে যে, গণতান্ত্রিক পরিসরে স্বশাসিত তদন্তকারী সংস্থাগুলি কতটা নিরপেক্ষ এবং কতটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত?
ঘটনা কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার স্ত্রী বিএম পার্বতী এবং ওই রাজ্যের নগরোন্নয়ন মন্ত্রী বাইরাথি সুরেশের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলার প্রেক্ষিতে ইডি-র আনা আবেদন-সংক্রান্ত। ‘মহীশূর আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’-র মাধ্যমে অবৈধভাবে প্লট বরাদ্দের অভিযোগকে কেন্দ্র করে মামলা হয়েছিল। কিন্তু ট্রায়াল কোর্ট ও কর্নাটক হাই কোর্ট– দুই স্তরেই এই অভিযোগ খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তবু ইডি সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে।
প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই প্রশ্ন তোলেন, ‘একক বিচারপতি যখন ট্রায়াল কোর্টের আদেশ বহাল রেখেছেন, তখন কেন আবার আপনারা আবেদন করছেন? রাজনৈতিক লড়াই জনগণের ময়দানে হোক। আপনারা কেন ব্যবহৃত হচ্ছেন?’ বিচারপতির এই উক্তি যেন রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি গভীর অসুখের দিকে আঙুল তোলে– যা নির্বিচারে ও একপাক্ষিকভাবে তদন্তকারী সংস্থাকে ব্যবহার করে বিরোধী-কণ্ঠ রোধ করার প্রবণতা। বিচারপতি গাভাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও বলেন, মহারাষ্ট্রে ইডির ভূমিকা নিয়ে তঁার অসন্তোষ ছিল স্পষ্ট। তঁার সতর্ক-মন্তব্য, ‘আমরা কিছু বলতে বাধ্য হলে সেটা ইডির পক্ষে খুব কঠিন হবে শুনতে।’ এই পর্যবেক্ষণ শুধু আইনগত দায়মুক্তির প্রশ্নে নয়, বরং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যতের নিরিখে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
ইডি-র হয়ে আদালতে দঁাড়ানো অ্যাডিশনাল সলিসিটর জেনারেল এসভি রাজু আপিল প্রত্যাহারের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং অনুরোধ জানান, যেন এই সিদ্ধান্ত কোনও ‘নজির’ হিসাবে গণ্য না হয়। প্রধান বিচারপতি সাফ জানিয়েছেন, একক বিচারপতির সিদ্ধান্তের যুক্তির মধ্যে কোনও ভুল দেখছেন না, এবং তির্যককণ্ঠে বলেন, ‘আপনাকে ধন্যবাদ, কঠিন মন্তব্য থেকে আমাদের বঁাচানোর জন্য।’
এই পুরো পর্ব এক গভীর বার্তা দেয়, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল আদালতের নয়, বরং তদন্ত সংস্থারও। বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তদন্ত জরুরি। না-হলে আইনের পর্দার আড়ালে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা রচনা করার অভিযোগ বারবার উঠতেই থাকবে, এবং তার ফলে জন-আস্থা আরও ক্ষয়ে যাবে। এ কারণেই সুপ্রিম কোর্টের এই হস্তক্ষেপ নিছক একটি মামলার নিষ্পত্তি নয়, বরং গণতন্ত্র রক্ষার মৌলিক বার্তা। শীর্ষ আদালত মনে করিয়ে দিল, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক লড়াইকে হতে হবে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে।
(মতামত ব্যক্তিগত)