অর্পণ দাস: ফের ভারতের মাটিতে ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এক যুগ পর ঘরে ফিরেছে ক্রিকেটের বিশ্বযুদ্ধ। অধরা ট্রফির স্বাদ পেতে মরিয়া টিম ইন্ডিয়া। উৎসবের মেজাজে ব্যস্ত গোটা দেশে অবশ্য উন্মাদনার অভাব চোখে পড়তে বাধ্য। তবু যতই হোক, হাফসেঞ্চুরি পার করার পর প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজন। ১৯৭৩ সালের জুন-জুলাই মাসে শুরু হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপের পথচলা। এরকম ঐতিহাসিক বছরে ফের ভারতের হাতে কাপ উঠলে তো একেবারে সোনায় সোহাগা।
দাঁড়ান, দাঁড়ান! চমকে উঠছেন? প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপ তো হয়েছিল ১৯৭৫-এ। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই ভেবেছেন। কিন্তু সেটা ছিল পুরুষদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ। তারও দু’বছর আগে বিনুনি বেঁধে, সাদা জামা-সাদা স্কার্ট পরে একদল মহিলা মঞ্চ মাতিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম বিশ্বকাপ ছিল আক্ষরিক অর্থেই ক্রিকেট উৎসবের নামান্তর।

চলুন, টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরে আসা যাক ১৯৭৩ সালের ২০ জুনে। সেদিন লন্ডনে তুমুল বৃষ্টি। জামাইকা আর নিউজিল্যান্ড মহিলা ক্রিকেট দল ড্রেসিংরুমেই গোটা দিনটা কাটিয়ে ফেলল। কথায় বলে, ‘মর্নিং শো’জ দ্য ডে।’ অথচ ঐতিহাসিক টুর্নামেন্টের প্রথম দিনে বলই গড়াল না। এমনকী টস পর্যন্ত হয়নি। আকাশের মুখ ভার, দর্শকদেরও। এবারের বিশ্বকাপের মতো তখনও ছিল ‘রাউন্ড রবিন’ পর্যায়ের ম্যাচ। পার্থক্য হচ্ছে, সেমিফাইনাল-ফাইনাল হবে না। লিগ শীর্ষে থাকা দল হবে চ্যাম্পিয়ন। ৬০ ওভারের ম্যাচে জিতলে চার পয়েন্ট, ড্র হলে এক। শেষ ম্যাচ ২১ জুলাই।
মোট সাতটি দল ছিল সেবারের বিশ্বকাপে। তবে ভারত ছিল না। টেস্ট খেলিয়ে দল হিসেবে ছিল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড। আমন্ত্রণ জানানো হয় ত্রিনিদাদ-টোবাগো আর জামাইকাকে। ইংল্যান্ডের ‘বাড়তি’ প্লেয়ারদের নিয়ে তৈরি হয় ‘নিউ ইংল্যান্ড’ নামের আরও একটি দল। তবে বিপদ বাঁধল দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে। বর্ণবিদ্বেষের জন্য আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কবলে প্রোটিয়ারা। শেষ পর্যন্ত প্রতিটি দেশেরই আরও কিছু খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরি হয় ‘আন্তর্জাতিক একাদশ’ নামের একটি দল।
যাই হোক, প্রথম ম্যাচ ভেস্তে গেলেও দ্বিতীয় দিনে দুটি ম্যাচ নির্বিঘ্নেই মিটল। টিনা ম্যাকফেরসনের পাঁচ উইকেটে মাত্র ৩১ ওভারে নিউ ইংল্যান্ডকে ৫৭ রানে অল আউট করে দেয় অস্ট্রেলিয়া। অন্য ম্যাচে আন্তর্জাতিক একাদশের বিরুদ্ধে ২৫৮ রান তোলে ইংল্যান্ড। ওই দিন বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরির নজির গড়েন লিন থমাস ও এনিড বেকওয়েল। ইংল্যান্ড ম্যাচটি অনায়াসে জিতেও নেয়।
অবশেষে ২১ জুলাই, বহুপ্রতীক্ষিত ‘ফাইনালে’র দিন। মুখোমুখি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ৫ ম্যাচে ১৭ পয়েন্ট সংগ্রহ করে লিগ শীর্ষে অস্ট্রেলিয়া। বৃষ্টির জন্য তাদের একটি ম্যাচ ড্র হয়েছিল। অন্যদিকে সমসংখ্যক ম্যাচে ইংল্যান্ডের সংগ্রহ ১৬ পয়েন্ট। অর্থাৎ এজবাস্টনে যে জিতবে সেই চ্যাম্পিয়ন। টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করে ইংল্যান্ড। ফের সেঞ্চুরি হাঁকান সেই এনিড বেকওয়েল। ইংল্যান্ড তোলে ২৭৯ রান। জবাবে ৬০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে অস্ট্রেলিয়া রান ১৮৭। বল হাতেও ২ উইকেট পান এনিড। ২৬৪ রান করে তিনিই সেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানশিকারি। ইংল্যান্ডের রোজালিন্ড হেগস ১২টি উইকেট নেন। অধিনায়িকা র্যাচেল হেহো ফ্লিন্টের হাতে সুদৃশ্য বিশ্বকাপ ট্রফিটি তুলে দেন ইংল্যান্ডের রাজকন্যা অ্যানি অফ এডিনবরা।

আরেকজনের কথা না বললে বোধহয় প্রথম বিশ্বকাপের কথা ফুরোয় না। তিনি ‘স্যর’ জ্যাক আর্নল্ড হেওয়ার্টস। পেশায় ব্যবসায়ী হলেও মন পড়ে থাকে খেলার মাঠে। ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব উলভসের প্রেসিডেন্টও ছিলেন জ্যাক। বিশ্বকাপের আগে ইংল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেট দল ক্যারিবিয়ান সফরে গিয়েছিল। তার পুরো খরচ বহন করেছিলেন জ্যাক। যা ছিল ক্যারিবিয়ান দল দুটিকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ‘অফিসিয়াল’ সফর। আসলে বিশ্বকাপের আগে থেকেই জ্যাক ও ফ্লিন্ট নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জ্যাক জানতেন মহিলাদের বিশ্বকাপের বিরাট খরচ ইংল্যান্ড বোর্ড বা আইসিসির পক্ষে বহন করা প্রায় অসম্ভব। তাই নিজের গ্যাঁট থেকে ওই সময়ে ৪০ হাজার পাউন্ড খরচ করে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব নেন।

বিশ্বকাপে মাঠে জিতেছিল ইংল্যান্ড। মাঠের বাইরে জিতেছিল ক্রিকেট। একমাস ধরে উৎসবের আবহ ছিল ইংল্যান্ডে। মাঠের ফলাফলের বাইরে প্রতিটি প্লেয়ার উদযাপন করেছিলেন ক্রিকেটকে। বৃষ্টিবাদলাও তাঁদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। ধবধবে সাদা পোশাকে সবুজ ময়দানে ছুটে বেরিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রিকেটাররা। হ্যাঁ, মহিলা বা পুরুষের ভেদাভেদে নয়, শুধু ক্রিকেটাররা। কখনও সজোরে এসে বল ভেঙে দিচ্ছে উইকেট। কিংবা কবজির আলতো মোচড়ে বল পৌঁছচ্ছে বাউন্ডারিতে। উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছেন দর্শকরা। ব্যাটের ঠিক মাঝখানে লাল দাগে লেখা হচ্ছে ইতিহাস। ভারত সেই বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি। কিন্তু তার পরের অধ্যায়, অর্থাৎ ১৯৭৮-এ ভারত মহিলাদের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজন করে। সেই ‘গল্প’ অবশ্য এই লেখার বিষয় নয়। এরপরও কয়েকবার এদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ হয়েছে। আর এবার উৎসবের মাঝে আরও এক উৎসবের আয়োজন। পরিবেশ আদপে উৎসাহব্যঞ্জক না হলেও আবেগের রং বদলে যেতে কতক্ষণ? বিশেষত যে প্রতিযোগিতার এমন বর্ণময় ইতিহাস রয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
নিয়মিত খবরে থাকতে ফলো করুন