ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা যাবে না

ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করা যাবে না

খেলাধুলা/SPORTS
Spread the love


শুভঙ্কর চক্রবর্তী

‘চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী’- চৌর্যবৃত্তির খোলাবাজারে প্রাচীন প্রবাদটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। কারণ, চুরি করাটাই এখন ধর্ম। ডুয়ার্সের বালি মাফিয়ারাও সেটা ভালোই বুঝেছে। তারা জানে, প্রশাসনিক সভায় মুখ্যমন্ত্রীর ধমক খেয়ে একটি বাক্য বলতে গিয়ে দশবার ‘হ্যঁা, ম্যাডাম’, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম’ বলা বাবুরাও কড়কড়ে নোট পেলেই সাদাকে কালো করতে দু’সেকেন্ড ভাবেন না। তাদের ধর্মের মূলমন্ত্রই হল, ‘ফ্যালো কড়ি, মাখো তেল’। তাই ‘হপ্তা’/‘মান্থলি’/‘ইএমআই’/‘পারসেন্টেজ’- বিভিন্ন প্যাকেজে পুলিশ, প্রশাসন, নেতা-মন্ত্রীদের কিনে নিচ্ছে মাফিয়ারা। আর তার বিনিময়ে দেদারে লুটছে লিস, ঘিস, চেল, তিস্তা, জলঢাকার মতন ছোট-বড় নদীগুলিকে।

রাজপথ বা কানাগলিতে মাফিয়ার সঙ্গে নেতা বা পুলিশের গলাগলির কথা এখন আর কারও অজানা নয়। কিন্তু সর্বজনবিদিত সেই সত্য কথা বললেই খাঁড়া নেমে আসছে সাধারণ মানুষ থেকে সংবাদমাধ্যম সবার ওপরে। যেমনটা হল শনিবার রাতে মালবাজারে। ডাম্পারনগরী ওদলাবাড়িকে এপিসেন্টার করে বালি পাচারের কারবারের কথা কে না জানেন? নদীর ধার বরাবর অবৈধ ক্র্যাশারের কারবার, নদীর চর দখল করে ডাম্পারের বেআইনি স্ট্যান্ডের কথা প্রশাসন বা পুলিশের কর্তারা জানেন না সেকথা ডুয়ার্সের কোনও সুস্থ মানুষই বিশ্বাস করবেন না।

ঘিসবস্তির ঘোষিত বালি মাফিয়া এখন অর্ধেক ডুয়ার্সের ত্রাস হয়ে উঠেছে। খুনের মামলার আসামি ওই মাফিয়ার দৌরাত্ম্য নতুন নয়। শাসকদল তৃণমূলের আশীর্বাদে সে এখন নেতা হয়েছে। জলপাইগুড়ি জেলা তৃণমূল যুব নেতৃত্বের তালিকাতে তার নাম উঠেছে। সে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছে, ‘পুলিশকে মান্থলি দিই। কেন পুলিশ ডাম্পার আটকাবে।’ কতটা স্পর্ধা হলে একথা বলা যায় ভাবুন। বলাই বাহুল্য শাসকদল তাকে ওই স্পর্ধা দিয়েছে। নানা কুকীর্তির কথা জেনেও তার মাথায় হাত রেখেছেন জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা ও এক মন্ত্রী। কেন? কোন উদ্দেশ্যে? প্রশ্ন তো উঠবেই।

তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলেই দলের ডুয়ার্সের এক প্রভাবশালী নেত্রী সম্পর্কে নানা কথা শোনা যায়। নেত্রীর ভাই কীভাবে বালির কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে সে কথাও আর গোপন নেই। আপাতদৃষ্টিতে ‘সাদাসিধে’ মন্ত্রীর ছেলের নানা কুকীর্তিও পর্দার বাইরে এসেছে। বাবার হয়ে ছড়ি হাতে নিয়ে ছেলে এখন তোলাবাজির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। কখনও ভাই, কখনও ছেলেকে সামনে রেখে বেআইনি কারবারের গতি ও রুট নিয়ন্ত্রণ করার অভিনব ফন্দি এঁটেছেন নেতারা। কিছু সময়ের জন্য বৈধ-অবৈধর প্রশ্ন সরিয়ে অন্য কথায় আসি। জলপাইগুড়ির পুলিশকর্তারা সাফাই দিয়ে জানিয়েছেন, যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী গ্রামীণ রাস্তায় ভারী ডাম্পার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তাই রাত্রি দশটার পর জাতীয় সড়ক হয়ে মালবাজারের মধ্য দিয়ে জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়িতে যাবে বালিবোঝাই ডাম্পার। মালবাজার ছোট্ট শহর। রাস্তাও তেমন সম্প্রসারিত নয়। হঠাৎ করে সেখানে শতাধিক বালিবোঝাই ডাম্পার ঢুকে গেলে সমস্যা তো হবেই। নাগরিক নিরাপত্তার কথা পুলিশকর্তারা ভুলে গেলেন কী করে।

মালবাজার হয়ে জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি পৌঁছাতে হলে যে রুটেই ডাম্পার চালানো হোক না কেন তা চালাতে হবে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে। রাতভর বন্যপ্রাণীদের যাতায়াতের রাস্তা দিয়ে শয়ে-শয়ে ডাম্পার চললে তা পরিবেশের পক্ষে সুখকর হবে তো?

রাতে জঙ্গলের পথে ডাম্পার ঢুকিয়ে বন্যপ্রাণের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে তার দায় কে নেবে? বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় ডুয়ার্সের পথে গতি কমিয়েছে রেল, রাতে মালগাড়ি চলাচলও অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। অথচ রেলের উলটো পথে হাঁটছে রাজ্য পুলিশ। কি অদ্ভুত কাণ্ড! রয়্যালটি জাল করে বা একই রয়্যালটি বারবার ব্যবহার করে বালি পাচারের নানা কৌশলে পটু হয়ে উঠেছে মাফিয়ারা। সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই পুলিশের।

নিয়ম বলছে, সন্ধ্যার পর নদী থেকে বালি তোলা নিষিদ্ধ। সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আর্থমুভার নামিয়ে ডুয়ার্সের নদীগুলোতে সন্ধ্যা থেকে ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত অপারেশন চালাচ্ছে মাফিয়ারা। সেই কারবারে যাতে কোনওরকম বিঘ্ন না ঘটে তারজন্য পোষা হচ্ছে গুন্ডাবাহিনী। সেই গুন্ডারাই ভোটের সময় নেতাদের হয়ে মাঠে নামছে।

সব জেনেও কেন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে আছেন প্রশাসনের আধিকারিকরা সেটাই সবাই জানতে চান। আসলে রক্ষকরা ভক্ষক হলে যা বিপদ হওয়ার তাই হচ্ছে। সাধারণ মানুষ ঘোরের মধ্যে রয়েছেন।

প্রতিবাদ করা উচিত কি না বা কতটা করা উচিত, কতটুকু প্রতিবাদ করলে আক্রমণের খাঁড়া নেমে আসবে না সেটা ভেবে প্রতিবাদের শব্দ চয়ন করতে হচ্ছে। প্রশাসন, পুলিশ, নেতাদের বোঝা উচিত, ভয় দেখিয়ে সবার মুখ বন্ধ করা যায় না, যাবেও না। মাফিয়ারা যেমন আছে, তেমনি এই সমাজে ভালো মানুষেরও অভাব নেই। সেই ভালো মানুষই রাস্তা দেখাবেন। মাফিয়া এবং তাদের মদতদাতাদের নাম কালো তালিকাতেই নথিভুক্ত থাকবে।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *