অন্য এক অরণ্যে আমি পোস্টম্যান – Uttarbanga Sambad

অন্য এক অরণ্যে আমি পোস্টম্যান – Uttarbanga Sambad

ব্যবসা-বাণিজ্যের /BUSINESS
Spread the love


  • রঙ্গন রায়

ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। মা-বাবার সঙ্গে পুজোয় ভাগলপুর গিয়েছি। মায়ের মাসির বাড়ি সেখানে। বনেদি বাড়ি। নানা শরিকে ভাগ হয়ে গেলেও দুর্গাপুজো হয়। উৎসবমুখর হয়ে ওঠেন সবাই। অত বড় বাড়িখানা পেয়ে দাপিয়ে খেলে বেড়াচ্ছি। চারদিকে ঘর মাঝখানে উঠোন। তারই এক কোনায় বিরাট বড় এক চৌবাচ্চা। সেটা আর ব্যবহার করা না হলেও ভেঙে ফেলা হয়নি। কারণটি বেশ উত্তেজনাময়। মায়ের মেসোমশাইয়ের কলেজের সহপাঠী ছিলেন নাকি স্বয়ং মহানায়ক উত্তমকুমার। তিনি বন্ধুর বাড়ি এসে একবার এই চৌবাচ্চাতেই স্নান করেছিলেন। স্মৃতি ধরে রাখা হয়েছে।

গোটা পুজোটাই ভাগলপুরে ঘুরে বেরিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কিশোরকুমারের মামাবাড়ি দেখে, গঙ্গায় সাঁতার কেটে কাটিয়ে দিলাম। দশমী এল। প্রবল বর্ণাঢ্য বিসর্জন হল। তারপর ঘাট থেকে ফিরে দশমী প্রণাম। এখানে বিজয়া করবার যে রেওয়াজ দেখেছি, তা সারাজীবন মনে থেকে যাওয়ার মতো।

প্রথমেই বাড়ির লম্বা বারান্দায় সকলে মিলে পরপর লাইন দিয়ে বসলাম। সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, আশীর্বাদ করলেন, হাতে রসগোল্লা দিলেন। আমরা ঢিপঢিপ করে তাঁকে প্রণাম করলাম। এরপর তাঁর চেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ যিনি, তিনি এলেন। প্রত্যেকের মিষ্টি আলাদা। এবার সন্দেশ। তারপর এল লাড্ডু। তারপর মুড়ির মোয়া, জিভেগজা, শনপাপড়ি– ইত্যাদি কত যে সুখাদ্য তার ইয়ত্তা নেই। প্রত্যেকে ক্রমান্বয়ে আশীর্বাদ করেন আর মিষ্টি খেতে খেতে প্রাণ ভরে ওঠে। সেখানে কত হাসি-মজা-আনন্দ-ভালোবাসা। কিন্তু কোথায় যেন একটা বিষাদ। একটা শূন্যতা। আর তাকে আড়াল করবার জন্যই যেন এই আয়োজন। শুভ বিজয়া বলতে আমার এ স্মৃতিটাই ভেসে ওঠে মনে।

দুর্গাপুজো আমাদের প্রভূত আনন্দ দিয়ে চলে যায়। তার সঙ্গেই বিদায় নেয় শরৎও। প্রতিবছরই এই নিয়মের কোনও ব্যত্যয় হয় না। বাতাসে থাকে নরম একটি ছোঁয়া। সকালবেলা সবুজ ঘাসজমিতে সেজেগুজে পড়ে থাকে শিউলি ফুলের দল। যখন ছোট ছিলাম, দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার শূন্যতা মন খারাপ করে দিত। মন খারাপের সংগত কারণ অবশ্য অন্য ছিল। প্রতিমা বিসর্জন ও প্যান্ডেল খুলে ফেলার পর ফাঁকা জমিটা বেশি করে মনে করিয়ে দিত, এখনই, হুট করেই এসে পড়বে কালীপুজো, আর সেটা শেষ হলেই করাল দর্শন ফাইনাল পরীক্ষা। কিন্তু শুধুই কি পরীক্ষার জন্যই এই বিষণ্ণতা?

পুজো বলতেই আমার ভীষণ মনে পড়ে যায় মামাবাড়ির কথা। বিজয়ার শূন্যতা বলতেও সেই মামাবাড়ি। ছোটবেলায় আমি পুজোর ছুটি পড়লেই চলে যেতাম নেপাল থেকে সাত কিলোমিটার দূরে, ফুলবাড়ি টি এস্টেটের কোয়ার্টারে। সেই হাতি-চিতাবাঘ সংকুল অরণ্য নিকটবর্তী বিশাল কারখানার মণ্ডপে হত দুর্গাপুজো। ওরকম ধুমধাম আমি শহরেও খুঁজে পাইনি। সারাবছর সাইরেনের শব্দ ধরে হাড়ভাঙা খাটুনি, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, প্রতি পদে সাপ, বিছে, হাতি আর চিতাবাঘের ভয়কে সঙ্গী করে বেঁচে থাকার মধ্যে একদিন হঠাৎ ঘন চা বাগানে তিরতির করে বয়ে চলা খেমচি নদীর ধার ঘেঁষে গজিয়ে ওঠে অমোঘ কাশফুল। আর তারপরই ট্র্যাক্টরে করে মাটি, খড়, বাঁশ, ছাঁচ আর যাবতীয় জিনিস নিয়ে চলে আসেন মূর্তি গড়ার কারিগর। পুজোর গন্ধ ছুটে যায় সমগ্র বাগানে।

শয়ে-শয়ে মদেশিয়া শ্রমিক নারী-পুরুষ, আর তাঁদের রংবেরঙের পোশাক পরা ছেলেমেয়ের দলে ভরে উঠত কারখানার ঠাকুরদালান; কলকাকলি আর ঢাকের বাদ্যিতে সকলের কোমর ধরে নাচ, আমাকে আজও মনে করিয়ে দেয়, ক্যাপ বন্দুক ফাটানোর উত্তেজনা, রাতের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মালিক-শ্রমিক এক হয়ে যাওয়া।

 দিদিমাকে ‘উইমা’ বলে ডাকতাম। কীভাবে যেন সবসময়ই আমি উইমার মুখেই খুঁজে পেতাম ঠাকুরদালানের উমার মুখ। দশমীর পরদিন খাঁখাঁ মণ্ডপ দেখে মন খারাপ করে জানলার ধারে বসে থাকলে, টকটকে ফর্সা হাত দিয়ে উইমা যে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন আমার কৃষ্ণবর্ণ গায়ে, তাতে কী অপূর্ব ভঙ্গিমায় কেটে যেত কষ্ট! শূন্যতার অনুভব।

এই তরুণ বয়সে এসে দেবীর বিদায় মানে আমার কাছে জলপাইগুড়ির বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়ির বিসর্জন। গোটা শহর উপচে পড়ে সেখানে। বাদ্যিকরের ঢাকের কাঠিতে যে ঝংকার ওঠে শব্দের, তাতে কীভাবে যেন বিদায়ের সুরটাও স্পষ্ট বোঝা যায়৷ মন আপনে আপ খারাপ হতে শুরু করে। যেন জানি এখনই শূন্য হব। রিক্ত হব। তবুও, সবাই মিলে মেতে উঠি দেবীর চলে যাওয়ার যাত্রাপথে।

রাজবাড়ির পুকুরপাড়ে অগণিত জনতার সামনে ঢাকের বাদ্যমুখরিত বাতাসে যখন কাঠামো সহ দেবীকে কয়েক পাক ঘুরিয়ে বিসর্জন দিচ্ছে সবাই, তখন অজান্তেই ফুঁপিয়ে ওঠে প্রবীণ থেকে নবীন শহরবাসী। খুব ধীরে ধীরে, গুটিগুটি পায়ে যেভাবে নেমে আসে অন্ধকার, তেমনই পুকুরের জলে তলিয়ে যেতে থাকেন সুসজ্জিতা দেবী দুর্গা। প্রতি পলে অনুপলে তলিয়ে যাচ্ছেন দেবী আর আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জয়ধ্বনি উঠছে। শেষমুহূর্তের নাচে ধূলিধূসরিত হয়ে যায় সমগ্র চরাচর। আর সেই ধুলো যত কাটতে থাকে, ততই প্রকট হয়ে ওঠে বিষণ্ণতা। শূন্যতার অভূতপূর্ব অনুভূতি। কিন্তু কীসের এই শূন্যতা?

আসলে দুর্গাপুজো যে বাঙালির কাছে কেবলই ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়! এটি সামাজিক উৎসব। বহুদূরের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা, নতুন জামা পরে ঘুরতে বেরোনো, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, রাতভর মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা— সব, সব মিলিয়ে এই কয়েকটি দিন বাঙালির বারো মাসের সেরা মুহূর্ত হয়ে ওঠে। তাই পুজোর অন্তিম ক্ষণে মনে হয়, হঠাৎই সব ফুরিয়ে গেল। যেন রাতভর আলো জ্বলে ওঠার পর, ভোরে এক লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে অন্ধকার ঘরে ফিরে আসতে হচ্ছে।

বিদায়ের এই আবহে সবচেয়ে সুস্পষ্ট যে বিষয়টি অনুভব করা যায়, তা হল শূন্যতা। ঢাকের তালে, ধূপধুনোর গন্ধে, উলুধ্বনিতে যে ঘোর তৈরি হয়, তা দশমীর জলস্নাত প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই ভেঙে যায়। জলের হৃদয়ে প্রতিমা মিশে যেতে থাকে, গলে যেতে থাকে মৃত্তিকা, আর মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে তটের ধারে। সকল লোকের মাঝে, কিন্তু নিজেরই মুদ্রাদোষে–একা। নিঃসঙ্গ।

নতুন জামার ঝলক ম্লান হয়ে যায়। রাস্তার আলোও নিভে আসতে শুরু করে, মাইক হয়ে যায় বন্ধ। মনে হয় যেন গোটা শহর–গ্রাম ক্লান্ত হয়ে নিদ্রায় ডুবে যাচ্ছে। অথচ হৃদয়ের ভেতরে তখন একটাই প্রশ্ন—আবার কবে আসবে মা?

এই শূন্যতার মুহূর্তে আসলে যে বেদনাটি জন্ম নেয়, সেটি বিজ্ঞানসম্মত। আনন্দ যত বেশি, তার বিদায়ের বেদনাও ততই তীব্র। ততই অপার্থিব। আমরা জানি দেবী প্রতি বছর আসবেন। আশ্বিনের শারদপ্রাতে দিকে দিকে যখন জ্বলে উঠবে আলোকমঞ্জির, তখন তিনি ফিরবেনই। তবুও এই বিদায়ের ব্যথা যেন কমে না। তার আরেকটা কারণ অবশ্য প্রকৃতিও।

পুজোর পরপরই তীব্রভাবে জাঁকিয়ে বসে হেমন্তকাল। বিষণ্ণ হেমন্তকাল। দুপুরটা শেষ হলেই কেমন যেন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের মতো দশা হয় রোদের। মন কিছুতেই ভালো লাগে না। প্রতিটি মানুষই যে যার কর্মজীবনে ফের ব্যস্ত হয়ে পড়ে। উত্তেজনা ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। ঋতুর এই বিষণ্ণতা দেখেই হয়তো শক্তি চাটুজ্জে একদিন ভেবেছিলেন, হেমন্তের এ অরণ্যে একজন পোস্টম্যানের খুব প্রয়োজন।

আর তাই শূন্য পোস্টকার্ড নিয়েই আমরা আজও পোস্টম্যান হয়ে দোরে দোরে ঘুরি, বিজয়া করতে যাই পুনর্মিলনের সাধে। কিন্তু শৈশবের সেইসব দিন ফেরে না। যেভাবে বাবা আর কখনও নিয়ে যাবে না ভাগলপুর, যেভাবে ভাগলপুরে মায়ের মাসিরা কেউ আর থাকে না। যেভাবে উমার সঙ্গে উইমাও চলে গিয়েছে আমাকে ছেড়ে, একা, উমার কাছে। আমি শুধু পোস্টকার্ড লিখে যাই। স্বর্গের ঠিকানায়।



Source link

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *